নেতৃত্বে ছাত্রদল

২২ বছর পর আবার ‘ছাত্র ঐক্য’, এবার বাদ ছাত্রশিবির

ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির
ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির  © লোগো

২০০১ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ১০টি ছাত্রসংগঠন নিয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে’র আত্মপ্রকাশ করেছিল। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে সেই ছাত্রজোটের সামনের সারিতে ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। ওই বছরের শেষের দিকে ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট। ২২ বছর পর আবার আত্মপ্রকাশ করেছে ছাত্রদলের নেতৃত্বে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য’।

তবে ১৫টি ছাত্রসংগঠনের নতুন এই জোটে জায়গা হয়নি ছাত্রশিবিরের। তাছাড়া এই জোটে নেই আরেকটি ইসলামী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের। শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত প্রতিনিধি সভায় এই ছাত্র জোটের নাম ঘোষণা করা হয়।

২০০১ সালে ১০টি ছাত্রসংগঠন থেকে এবার ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যে’ ৫টি রয়েছে। বাকি ৫টি বাদ পড়েছে। তবে এবার যুক্ত হয়েছে আরও ১০টি নতুন ছাত্রসংগঠন। বাদ পড়াদের মধ্যে অধিকাংশ ডানপন্থী ছাত্রসংগঠন। যার মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির,  ইসলামী ছাত্রসমাজ, ইসলামী ছাত্রনতুন মজলিস, বাংলাদেশ ছাত্রশক্তি ও মুসলিম ছাত্রলীগ।  

নতুন এই জোটের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই জোট করার পেছনে মূল লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। আগামীতে এ নিয়ে তারা নানান কর্মসূচি-আন্দোলন হাতে নেবে। তবে এই জোটে ইসলামী দলগুলোকে নেয়া হলে সরকার অপপ্রচার চালিয়ে সেই আন্দোলন বানচাল করতে পারে। এছাড়াও নানা ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হওয়া, বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটও এখানে কাজ করেছে। এ কারণে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ছাড়াই ছাত্র জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যের জোটে থাকা ১৫ ছাত্রসংগঠন হলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রলীগ (জেএসডি), গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম-মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাতীয় ছাত্র সমাজ (বিজেপি-পার্থ), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বিপ্লবী ছাত্র সংহতি এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

এই জোটের মুত্রপাত্রের দায়িত্বে থাকবেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল। তিনজন থাকবেন সমন্বয়কের দায়িত্বে। তারা হলেন-ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদিব ও ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান রিচার্ড। জোটের বাকি নেতারা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

তাদের ৯ দফার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার মান উন্নয়ন, মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে জাতীয় অনুবাদ সংস্থা গঠন, মেধা ও যোগ্যতার শিক্ষা গ্রহণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাস ও দখলদারমুক্ত করা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান প্রভৃতির দাবির পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ নিবর্তনমূলক সব আইন বাতিল করা।

এ নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান জানান, জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্রশিবিরেরর আন্দোলন— মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ। তারা রাজপথে নামছে না। গত মাসে আমরা সারা দেশে কয়টা সমাবেশ করেছি। আর তারা কয়টা করেছে। যেহেতু রাজপথে তাদের অবস্থান পরিষ্কার নয়, তাই তারা এখানে নেই। তবে আমরা যে শুধু ১৫টি ছাত্রসংগঠন নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবো এমন নয়। আন্দোলনের ফাকেঁ ফাকেঁ কেউ যদি রাজপথে আমাদের সঙ্গে আসে তাহলে আমরা এই জোটে নেব। 

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, ৯ দফার ভিত্তিতে বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ক্রিয়াশীল গণতান্ত্রিক ছাত্রসংগঠনগুলোকে নিয়ে গঠিত জোট ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যের নাম ঘোষণা করছি। আগামীতে আমরা একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করবো। 

তিনি বলেন, ছাত্র ঐক্যের ৯ দফার প্রতি আগামীতে কোনো সংগঠনের সমর্থন থাকে তাহলে তাদের জন্য দরজা খোলা আছে। তাছাড়া কোনো চরমপন্থা না থাকে, রাজপথে আন্দোলন করে তাহলে তারাও এখানে জয়েন করতে পারবে।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিবুর রহমান বলেন, আজকের যে ঐক্য হয়েছে, আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করবে আমরা তাদেরকে সমর্থন জানাই। আমরাও রাজপথের আন্দোলনে আছি। প্রয়োজনে আগামীতে এ ধরনের কোনো ঐক্য হলে সেখানে সরাসরি আমরা থাকবো।

ছাত্রদলের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা হাস্যকর বিষয়। একক ছাত্রসংগঠন হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে আমরা ছাত্রদল থেকেও বেশি মিছিল মিটিং-মিছিল করেছি। হয়তো তারা যুবদল, বিএনপির সাথে প্রোগ্রাম বেশি করেছে। কিন্তু ছাত্রসংগঠন হিসেবে আমরা তাদের থেকে বেশি আন্দোলন করেছি।

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি শরিফুল ইসলাম রিয়াদ বলেন, বৃহৎ ছাত্রজোটকে অকার্যকর করতে এবং একটি নির্দিষ্ট মহলের চাপে সরকারকে সুবিধা দিতেই হুট করে কিছু সংগঠনকে নিয়ে জোট ঘোষণা করা হয়েছে। যা ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করবে। 

তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম চলমান সংকট উত্তরণের জন্য সকল মতের ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে একটি প্লাটফর্ম গড়তে। কিন্তু দেখা গেলো-বৃহৎ ছাত্রসংগঠনের অনেককে বাদ দেয়া হয়েছে। কাদের ইন্ধনে এমন একটি বিতর্কিত জোট ঘোষণা করা হয়েছে তাদের খুঁজে জাতির সামনে মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। যারা জাতির বৃহৎ স্বার্থকে মাথায় রেখে নুন্যতম সমঝোতা করতে পারে না, তারা কিভাবে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে।

ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারিকুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে আমার জোট করেছি। এখানে ক্রাইটেরিয়া রাখা হয়েছিল যারা বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে তাদের রাখা হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত আগামীকে পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। সেটা সময় বলে দিবে। তাই প্রাথমিকভাবে ছাত্রশিবিরকে রাখা হয়নি। তাছাড়া আরও অনেক ছাত্রসংগঠন যোগাযোগ করেছিল, তাদেরও জোটে রাখা হয়নি।

নামসর্বস্ব ‘ছাত্র ঐক্য’ দিয়ে ছাত্রলীগকেও ঠেকানো যাবে না
সদ্য আত্মপ্রকাশ করা এই জোটকে ভুইঁফোড়-নামসর্বস্ব উল্লেখ করে এসব ঐক্য দিয়ে সরকার পতন তো দূরের কথা ছাত্রলীগকেও ঠেকানো যাবে না বলে দাবি করেছে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা।    

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী ইনান বলেন, এগুলো ভুয়া ঐক্য, জনধ্বংসমুখী ঐক্য। ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করার জন্য তারা আতাঁত করছে। আমরা এ ধরনের ঐক্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির জানান, ভুইঁফোড়-নামসর্বস্ব সংগঠন নিয়ে গঠিত এই জোট নিয়ে ছাত্রলীগের কোন মাথাব্যাথা নেই। 

তিনি আরও জানান, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এখন ক্যাম্পাসগুলোতে সেশনজট নেই, অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই , মারামারি নেই , শিক্ষার সুস্হ্য অবস্হা বিরাজমান আছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পথে বাংলাদেশ ছুটছে তা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। আগামী নির্বাচনেও জনগণ আওয়ামীলীগে রায় দিবে।

ছাত্র ঐক্যকে জগাখিছুড়ি ঐক্য সাব্যস্ত করে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, এ বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবার কিছু নেই। তারা ১৫ টি দল নিয়ে যে ঐক্য করেছে সেখানে ১৫ জন কর্মী নেই। এটাকে একথায় বলা যায় একটি জগাখিচুড়ি ঐক্য। এই জগাখিচুড়ি ঐক্য দিয়ে আওয়ামীলীগকে ঠেকানো যাবে না। ছাত্রলীগকে ঠেকানো যাবে না। এই ঐক্য দিয়ে দেশের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব নয়। 

তিনি আরও বলেন, মানুষ দেখেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সেটি সামনে অব্যাহত থাকবে এবং তার জন্য ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে যাবে। এই পাঁচটা ছয়টা দল নিয়ে কে কোন জগাখিচুড়ি ঐক্য গড়লো সেটা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই।

ইতিবাচক বলছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’কে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো। এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাগিব নাঈম বলেন, এই ফ্যাসিবাদের জামানায় এ ধরনের পদক্ষেপকে নিশ্চিতভাবে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমাদের ও একটি জোট রয়েছে যার নাম গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। আমরাও এই ফ্যাসিবাদের পতন চাই। সুতরাং যারাই এই দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করবে তাদের সাধুবাদ জানাই। একিসাথে যারা জোট করেছে তারা ক্ষমতায় এসে এই ধরনের ফ্যাসিবাদে জড়াবেনা এমন অঙ্গীকারও চাই।    

বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী সভাপতি সাদিকুল ইসলাম বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সবাইকে নানাভাবে ঐক্য হওয়া প্রয়োজন। তাদের অধিকাংশের দাবির সাথে আমরাও একমত। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে আন্দোলন করতে হবে। 

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট এর সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন আমরাও ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে আছি। যে যার জায়গা থেকে লড়াই জারি রাখুক। তবে আমরা শুধু আওয়ামীলীগ নয়, এই ফ্যাসিবাদ ব্যাবস্থাকে ধ্বংস করতে চাই।


সর্বশেষ সংবাদ