‘ম্যানার’ শেখানো নেতারাই বিপথে, ইমেজ ফেরানোর চেষ্টায় ছাত্রলীগ
- খালিদ হাসান, ঢাবি
- প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:২৬ AM , আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:১৪ AM
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে সপ্তাহে কয়েকদিন বসে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ সভা। সেখানে জুনিয়র ছাত্রদের ডেকে ‘ম্যানার’ শেখান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সভায় শিক্ষার্থীদের নির্যাতন নিপীড়নের অভিযোগ অসংখ্য। তবে ছাত্রলীগের দাবি, নতুন শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে আচার-আচরণ শিক্ষা দেন তাঁরা। সেই ম্যানার শেখানো নেতারাই এখন জড়াচ্ছেন ছিনতাই-চাঁদাবাজির মতো অপরাধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিনতাই-চাঁদাবাজির হার ক্রমেই বাড়ছে। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ছে ক্যাম্পাসে ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ মারামারি, সংঘাতের খবর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ছিনতাই বা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। কয়েকটি ঘটনায় অভিযুক্তরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বহিষ্কারের সাঁজা দিয়ে দায় সারছে।
এরইমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে স্মার্ট করতে ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে ছাত্রলীগ। এতে নেতা-কর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকতে বলা হয়েছে। এ নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কথাও বলছেন নেতারা।
জানা গেছে, শুধু চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হাফ ডজনের বেশি ছিনতাইয়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মারামারিসহ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিজেরা সংঘর্ষে জড়ানোর পাশাপাশি চাঁদাবাজি এবং ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের অভিযোগও ওঠে সংগঠনটির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। এতে সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগের।
তবে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কঠোর কোনও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। শুধু তাদের বহিষ্কার করেই ক্ষান্ত থেকেছে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করছেন। তাদের দাবি, ঢাবি প্রশাসন জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেই এমন ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক অবিভাবক সন্তানকে ক্যাম্পাসে অনিরাপদ ভাবছেন, হলে রাখতেও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
সংগঠনবিরোধী, শৃঙ্খলা পরিপন্থী, অপরাধমূলক এবং সংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি ছাত্রলীগের ২১ জন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন ঢাবি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এছাড়াও বেশ কয়েকটি এমন পদক্ষেপ নিলেও থামছে না অপরাধ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্রলীগ নবীন শিক্ষার্থীদের টানা এক বছর গেস্টরুমে ‘ম্যানার’ শেখানোর চেষ্টা করলেও তারা নিজেরাই ‘ম্যানার’ জানেন না। তারা ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের মারামারি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। নেতারা বলেন, গেস্টরুম না হলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা ক্যাম্পাসের সঠিক আদব জানতে পারবে না।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেখা যাচ্ছে তারাই কোনো আদব জানেন না। তাই তো প্রতিনিয়ত পত্রিকায় তাদের দ্বারা ঘটিত ছিনতাই-চাঁদাবাজির খবর পড়তে হচ্ছে। তাদের ‘অতিরিক্ত ম্যানার জানা ও মানার’ কারণে ঢাবির সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে প্রতিনিয়তই।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালি মন্দিরের সামনে পুলিশ পরিচয়ে বইমেলার চার ক্রেতা থেকে ৯০০ টাকা চাঁদাবাজি করার অভিযোগ ওঠে। পরে শাহবাগ থানা পুলিশ হাতেনাতে আটক করে দু’জনকে। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই নেতা বাংলা বিভাগের মোহাইমিনুল ইসলাম ইমন ও অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের রাজিব হোসাইন রবিন।
ইমন মাস্টার দা সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। তিনি ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। আর রবিন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি। তিনি ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের অনুসারী। তাদেরকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সেক্রেটারি শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কার করা হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি মাস্টার দা সূর্যসেন হলের প্রিন্সিপ্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আব্দুল মোতালিবের ভাগ্নি ও তার স্বামীকে মেরে ২২ হাজার টাকা ছিনতাই ও এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে দুই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা জয় ও সাজিদসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে চুরি, শ্লীলতাহানি ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ দিয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়।
আসামি দু’জন হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফাহিম তাজওয়ার জয় এবং তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের মো. সাজিদ আহম্মেদ। উভয়েই ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী। সূর্যসেন হল হলের কার্যনির্বাহী সদস্য ফাহিম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী। অপর সদস্য সাজিদ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী
গত ৬ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালযয়ের (বুয়েট) মসজিদের সামনে একটি কাভার্ডভ্যান আটকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না পেয়ে চালকের কাছে থাকা ১৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে পালানোর সময় ৩ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে শাহবাগ থানার একটি টহল টিম। তারা হলেন- থিয়েটার বিভাগের শিক্ষার্থী ফজলে নাবিদ সাকিল, ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট শিক্ষার্থী রাহাত রহমান ও সমাজকর্ম ডিপার্টমেন্ট শিক্ষার্থী সাদিক আহাম্মদ। তিনজনই ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী।
গত ১৫ জানুয়ারী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা মামলায় ঢাবি ছাত্রলীগের দুই নেতাকে কারাগারে পাঠান আদালত। কারাগারে পাঠানো ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম তানজির আরাফাত ওরফে তুষার। তিনি কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রাহুল রায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সহসম্পাদক। পরবর্তীতে তাদের ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার মরা হয়।
আরো পড়ুন: ক্যাম্পাসকে স্মার্ট করতে ঢাবি ছাত্রলীগের ১০ নির্দেশনা
গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সড়ক দুর্ঘটনার জেরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলে ও বাবাকে পিটিয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য ৩২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক নাজমুল হাসান রুপু, ফজলুল হক শাখা ছাত্রলীগের কর্মী মো. তারেকসহ অজ্ঞাতনামা প্রায় ১০-১৫ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় হত্যার উদ্দেশ্যে রড দিয়ে পেটায় এবং কিল-ঘুষি মেরে আহত করা এবং চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযুক্তরা সবাই ছাত্রলীগের ঢাবি সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের অনুসারী বলে পরিচিত।
কিছুদিন আগে অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হাসান সোহাগের বিরুদ্ধে রাজধানীর বঙ্গবাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে চাঁদা না দেওয়ায় ওই ব্যবসায়ীকে মোবাইলে ফোন করে গালিগালাজ ও হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছিল। ভাঙচুর করা হয়েছিল তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ঘটনার জেরে গত ১২ ফেব্রুয়ারী তাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ সব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মার্ট করতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ১০টি নির্দেশনা দিয়েছি। ইতোপূর্বে যারাই এসব শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল, সবাইকেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগ সবসময় জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে।
তিনি বলেন, মানুষ অন্য দলের নেতাকর্মীদের চেনে না, তারা জনসম্মুখে আসতেও ভয় পায়। সেখানে তাদের কর্মীরা কোথায় কি করছে, সেটাও না জানারই কথা। ছাত্রলীগ ১০০টি ভালো কাজ করলেও সেটা নিউজ হয় না। লাখো কর্মীদের কয়েকজন একটা খারাপ কিছু করলেই মিডিয়াগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিউজ করার জন্য।
সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘যারা প্রকৃতপক্ষে ছাত্রলীগ কর্মী তারা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়ায় না। কিন্তু অনেক সময় জড়িতরা নিজেদের স্বার্থে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে। তাদের জন্য ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। আমরা এসকল বিষয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে আছি। সাংগঠনিক শৃংখলার ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের র্যাগিং-মাদকের মতো বিষয়গুলো থেকে দূরে রাখতে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলছি।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি শাখা সভাপতি আসিফ মাহমুদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া চাঁদাবাজি-ছিনতাইসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড বাড়ছে, যার সঙ্গে জড়িত মূলত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। শুধু ঢাবি না অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তারা এ ধারা অব্যাহত রেখেছে। বেশ কিছুদিন ধরে এসবের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন সংবাদ পত্রিকার হেডলাইনে রয়েছে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি ছাত্রলীগের এই নেতৃত্বে যারা আছেন তারা আস্কারা দিয়েছেন। ফলে তারা যেকোনও ধরনের খারাপ কাজ করতে পিছপা হচ্ছেন না। ছাত্রলীগের নেতারা অপরাধীদের বহিষ্কার ছাড়া কিছুই করবে না। তাই ছাত্রসমাজকেই তাদের বিরুদ্ধে জাগতে হবে এসব অন্যায়, অনিয়ম, ছিনতাই প্রতিরোধ করার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমাদের কাজ একাডেমিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন মেধাবীদের নামে এমন অভিযোগ চলে আসে, তখন আমাদের এসব নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হয়। এর আগেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আমরা বেশ কিছু ছাত্রকে বহিষ্কার করেছি। এটা অব্যাহত থাকবে।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করতে ছিনতাই-চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে তাদের এক বিন্দু ছাড় দেয়া হবে না। কোনও অন্যায় সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না। এজন্য যেমন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন প্রশাসন সেটা গ্রহণ করবে। তাছাড়া এমন ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে যারা লিপ্ত, আমরা পুলিশকে বলে রেখেছি তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ এবং দ্রুততম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে।’