অনেক রেকর্ডের মালিক হয়েও কেন ট্রলের শিকার হচ্ছেন মুশফিক

মুশফিকুর রহিম
মুশফিকুর রহিম  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পর তাকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তার এই ছেড়ে দেয়া বা বাদ পড়ার বিষয়টা অনুমেয়ই ছিল অনেকের কাছে।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিমের টেস্ট বা ওয়ানডের মতো উজ্জ্বল না। তবে তিনি বেশ কয়েকটি রেকর্ডের মালিক। কিন্তু তার টি-টোয়েন্টি থেকে তার অবসরে এরই মধ্যে অনেকে বলছেন, ‘মুশফিক যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বাঁচালেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ছেড়ে’। এটাকে বাড়াবাড়ি বলছেন ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি।

তিনি বলেন, যে কোনও ক্রিকেটারের ক্রিকেট খেলাই কাজ, সেটা ভালো হতে পারে, খারাপ হতে পারে। সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় এমন ঘৃণা ছড়ানো মোটেও ভালো কোনও ব্যাপায় নয়।

কী ধরনের মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন মুশফিক

‘‘ক্রিকেটে আপনার অবদান- অবসর নেয়া’’। কোনও কোনও মন্তব্যে মুশফিকুর রহিমের স্ত্রীকে জড়িয়েও মন্তব্য করা হয়েছে। অনেকে মুশফিকুর রহিমের অনুশীলনের ভিডিও নিয়ে টিটকিরি করেছেন মন্তব্যে। আরও অনেকে লিখেছেন, ‘‘তিন ফর‍ম্যাটেই অবসর নেয়া উচিৎ ছিল।’’

ক্রীড়া অনুরাগী রায়হানুল ইসলামের মতে মুশফিকের সাথে সবাই এমন আচরণ করছে যেন সে কোনও অপরাধ করেছেন। আসলে কিন্তু তা না। মুশফিক সেরফ বিশ্বের মানদন্ডে তেমন ভালো খেলতে পারেনি।

তার মতে সমালোচনা যৌক্তিক, ‘‘তার পরিসংখ্যান নিয়ে কাটাঁছেড়া সেটাও ঠিক আছে, কিন্তু ব্যক্তি মুশফিককে এখন আক্রমণ করা হচ্ছে। যেটা কারও ক্ষেত্রেই কাম্য নয়।’’

সমর্থকদের কেউ কেউ মুশফিককে এভাবে আক্রমণের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে বলছেন মুশফিকের কিছুদিনের ব্যবহার। যখনই সমালোচনা আসে মুশফিক এমন কোনও কথা বলেছেন যেটা সমর্থকদের ক্ষুব্ধ করেছে। যেমন শ্রীলঙ্কার সাথে শতক হাঁকিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলনে সমালোচকদের এক হাত নিয়েছিলেন।

তখন তার স্ত্রীও ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘আপনাদের কাছে কি রিপ্লেসমেন্ট আছে?’’ মুশফিকুর রহিম ফেসবুকে এও লিখেছেন, ‘যখন আপনারা ঘুমিয়ে থাকেন তখন আমি অনুশীলন করি।’ এটা অনেক সমর্থককেই ক্ষুব্ধ করেছে। অনেকে এসব নিয়ে মজা নিয়েছেন।

তবে ক্রীড়া অনুরাগী রায়হানুল ইসলামের মতে, এসব কারণে হতে পারে। কিন্তু এগুলা তাকে আক্রমণ করার কোনও যুক্তি হতে পারে না।

মুশফিকুর রহিম ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ম্যাচে সহজ রানআউট মিস করেছিলেন, এরপর চলমান এশিয়া কাপে উইকেটের পিছনে কুশল মেন্ডিসের ক্যাচ ছেড়েছেন। এসব ম্যাচে সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশকে হারিয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশের সমর্থকদের অনেকেই মুশফিকের উইকেটকিপিং নিয়ে খুশি না।

২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় মুশফিক, সমালোচকদের আয়নায় মুখ দেখতে বলেছিলেন। এটা ক্রিকেট বিশ্লেষকরাও ভালোভাবে নেননি।

বাংলাদেশের আরেক ক্রিকেট সমর্থক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘মুশফিকের ধর্মীয় আচার আচরণের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। তিনি বাঘের লোগো ঢেকে রাখেন, এসব বাড়াবাড়ি অনেকের পছন্দ হয়নি’।

রায়হানুল ইসলাম আবার মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখিয়েছেন, ধর্ম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি নিজের ধর্ম পালন করে সেটাতে দোষের কিছু নেই। এখানে তিনি ফুটবলে বায়ার্ন মিউনিখের সাদিও মানেকে উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন যিনি সম্প্রতি ক্লাবের সাথে পানীয় বিয়ারের কোম্পানির ফটোশুটে গিয়েও বিয়ারের গ্লাস হাতে নেননি।

এর আগে দেখা গেছে ইংল্যান্ডের মইন আলী, আদিল রশিদরা সিরিজ জয়ের পর শ্যাম্পেইন দিয়ে উৎসব এড়িয়ে যান। এসব বিষয়, ‘একেবারেই ব্যক্তিগত’ বলছেন তিনি।

রায়হানুল ইসলাম এই কারণকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন না। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারই ধর্মীয় আচরণ মেনে চলেন। এটা কোনও কারণই না মুশফিককে অপছন্দ করার।’

আরও পড়ুন: ক্রিকেট দুনিয়ায় হাফিজকে 'প্রফেসর' ডাকা হয় কেন?

তিনি মনে করেন মুশফিক অনেক সময়ই মাঠে এমন আচরণ করেছেন যা সমর্থকদের মনে দাগ কেটেছে, ‘ক্রিকেট মাঠে সতীর্থ ক্যাচ ধরতে এগিয়ে আসায়, তাকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম।’ এই ঘটনা নিয়ে তখন তুমুল আলোচনা হয়েছিল।

ক্রিকেট পর্যবেক্ষক মাজহার মিঠুন বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা সবসময়ই চাপে। মুশফিক এই চাপ এখন নিতে পারছেন না। সেটা স্পষ্ট হয়েছে এবং তিনি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘‘এটা এমনই সিম্পল একটা ব্যাপার। বাংলাদেশে এমন কোনও বিকল্প নেই যে মুশফিকের জায়গায় অন্য কেউ এসে খেলে তার জায়গা নিয়ে নিতো। কিন্তু এখন তৈরি হয়েছে, লিটন দাস আছেন, সোহান আছেন, এনামুল হক বিজয়ও এখন জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছেন।’’

এখন আর মুশফিক আগের মতো অটো চয়েস নন বলছেন মাজহার মিঠুন। মুশফিকুর রহিমের খেলা নিয়ে, তার মাঠে ও মাঠের বাইরের আচরণ নিয়ে নানা সমালোচনা ঠিক আছে বলছেন মাজহার মিঠুন, কিন্তু কোনও ভাবেই আক্রমণ করাটা যৌক্তিক নয়। যেটা অনেকেই করছেন তার অবসরের সিদ্ধান্তের পর।

ভালো মন্তব্য করেছেন অনেকে

অনেকেই আছেন যারা ভালো ভালো মন্তব্য করেছেন, যেমন মনদীপ ঘরাই মুশফিকুর রহিমের পোস্টে লিখেছেন, ‘অর্জনগুলো যত্নে থাকুক’। চিবল সাংমা লিখেছেন, ‘ওয়েল ডান ব্রাদার। এবারে ওয়ানডে বিশ্বকাপে মনোযোগ দিতে পারবেন।’

বাংলাদেশের ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ রিফাত এমিল লিখেছেন, ধন্যবাদ, টেস্ট ও ওয়ানডের জন্য শুভকামনা।

ক্রীড়া লেখক রেজওয়ান রহমান সাদিদ লিখেছেন, ‘আপনার ক্যারিয়ারের জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এখন আপনি টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে মনোযোগ দিতে পারবেন। এই দুই ফরম্যাটে আপনার এখনও অনেক দেয়ার আছে। ধন্যবাদ ও শুভকামনা।’

বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও তার পোস্টে নিচে মন্তব্য করেছেন, ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেন লিখেছেন, ‘আপনাকে বাংলাদেশ মিস করবে।’

ক্রিকেট ভক্ত পুষ্পিতা কবির বলেন, ‘প্রথমত ব্যক্তিগতভাবে ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে আমার সবচেয়ে পছন্দের ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব মুশফিকুর রহিম। এখন একজনের ভালো মন্দ দিক গ্রহণ করেই আমরা তাকে নিজেদের পছন্দের আসনে বসাই।’ তবে তার মতে, ‘মুশফিক আয়নায় মুখ দেখা নিয়ে যেসব কথা বলেছেন সেগুলো না বললেও হতো।’

মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের অনেকগুলো রেকর্ডের মালিক। টেস্টে তিনিই সর্বোচ্চ রানের মালিক, বাংলাদেশের হয়ে এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চও মুশফিকুর রহিমের। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে তিনবার ডাবল সেঞ্চুরি তুলেছেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তিনি ১০২ ম্যাচ খেলে ১৫০০ রান তুলেছেন।

পুষ্পিতা কবির বলেন, ‘‘বাংলাদেশ তো খুব বেশি ম্যাচ জেতেনি। যা জিতেছে তার অনেকগুলোতেই মুশফিকের অবদান আছে। মানুষ এসব মনে রাখে না।’’ [সূত্র: বিবিসি বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ