দেখেশুনে কুরবানির গরু কিনুন: কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা ও অসুস্থ গরু চেনার উপায়
- বাকৃবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০৮:২৪ PM , আপডেট: ৩০ জুন ২০২৫, ০১:৪৪ PM

ঈদুল আজহা মানেই ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এক ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ কুরবানি। প্রতি বছর এই সময় ঘিরে ধর্মপ্রাণ মানুষজনের মধ্যে দেখা যায় একটি ভালো, সুস্থ ও শরিয়তসম্মত কুরবানির পশু কেনার চেষ্টা। তবে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এখন একটি ভালো গরু কেনা যেন শুধু ইবাদতের নয়, বরং এক কঠিন চ্যালেঞ্জও।
দেশের বিভিন্ন পশুর হাট ইতোমধ্যে জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামার থেকে ছুটে আসা গরু, ছাগল, মহিষে ভরপুর শহরের বড় বড় হাট। পশুর হাটে গিয়ে ঝলমলে গা, চকচকে চোখ আর স্বাস্থ্যবান দেহবিশিষ্ট গরু দেখে মুগ্ধ হন না এমন মানুষ কমই আছেন। কিন্তু এই বাহ্যিক স্বাস্থ্য সবসময় প্রাকৃতিক নয়- আধুনিক কৌশলের মোড়কে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গরুকে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করে বাজারে তুলছেন। ফলাফল হিসেবে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ধর্মীয় দিক থেকেও সৃষ্টি হচ্ছে প্রশ্ন
গত বছর কুরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। এর মধ্যে ১ কোটি ৪ লাখ ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কুরবানি দেওয়া হয়েছিল। কুরবানিকৃত পশুর মধ্যে গরুর সংখ্যা ছিল ৪৭ শতাংশ, ছাগল ৫০ শতাংশ, এবং বাকিগুলো মহিষ, ভেড়া ও অন্যান্য প্রজাতির।
যৌথভাবে কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে গরুই সবার প্রথম পছন্দ। এই বিশাল চাহিদাকে পুঁজি করে কিছু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় গরুকে অস্বাভাবিক দ্রুত মোটা করার জন্য ব্যবহার করছেন হরমোন ও স্টেরয়েড। যেমন ডেক্সামেথাসন, ওরাডেক্সন, ট্রেনবোলন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি। কিছু অসাধু খামারি কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরু বাজারে তুলে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছেন।
এসব রাসায়নিক উপাদান গরুর স্বাস্থ্যের তো ক্ষতি করেই, তার চেয়ে বড় ক্ষতি হয় মানবদেহে। এসব গরুর মাংস খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, হজমে সমস্যা হয়, লিভার ও কিডনির জটিলতা দেখা দিতে পারে। শিশুদের জন্য তো এসব একেবারেই বিষের মতো—শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে।
২০১০ সালের মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইন অনুযায়ী, পশুকে মোটাতাজা করতে হরমোন বা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইন কার্যকরের তেমন নজির নেই।
তাই কুরবানির আগে শুধু দামের দিকে না তাকিয়ে পশুর স্বাস্থ্য ও প্রকৃত অবস্থা যাচাই করা জরুরি। সঠিকভাবে গরু বাছাই না করলে আপনি যেমন প্রতারিত হবেন, তেমনি আপনার কুরবানিও হতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা গরু কিছু সহজ লক্ষণেই শনাক্ত করা সম্ভব। তার ভাষায়:
• এ ধরনের গরু স্বাভাবিকভাবে চটপটে নয়, নড়াচড়া কম।
• শরীরে হাত দিলে প্রতিক্রিয়া কম দেখা যায়।
• মুখের উপরের অংশ (মাজল) শুকনো, চোখ লালচে ও ক্লান্ত দেখায়।
• শরীরে পানি জমে থাকে, চাপ দিলে দেবে যায় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় নেয়।
• খাবারে আগ্রহ কম থাকে, অনেক সময় মুখ দিয়ে লালা ঝরতে পারে।
• লেজ নড়াচড়া কম করে, চামড়া খসখসে ও রুক্ষ দেখায়।
• অতিরিক্ত নরম মাংস থাকে, কারণ তাতে পানি জমে থাকে।
তিনি আরও বলেন, অসুস্থ গরুর ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণত যেসব লক্ষণ থাকে:
• গরুটি এক জায়গায় স্থির থাকে বা শুয়ে থাকে।
• তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে না।
• চোখ, নাক ও মুখ দিয়ে ময়লা বের হতে পারে।
• খাবারে অনীহা, জাবর কাটে না, মাজল শুকনো থাকে।
• চামড়া উষ্কখুষ্কু ও প্রাণহীন দেখায়।
উপযুক্ত গরু কেমন এবং কীভাবে চিনবেন সে সম্পর্কে বাকৃবির আরেক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে সাধারণত তিন ধরনের গরু দেখা যায়—দেশি, প্রিমিয়াম বা আঞ্চলিক, এবং শাহিওয়াল ক্রস। গরু সুস্থ ও কুরবানিযোগ্য কিনা, তা বোঝার জন্য সবচেয়ে আগে লক্ষ্য করতে হবে দাঁত ও শিঙ।
যদি মুখের নিচের চোয়ালে দুধদাঁতের পাশাপাশি কোদালের মতো দুটি ‘ইনসিসর’ দাঁত দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে গরুটি কুরবানির উপযুক্ত বয়সে পৌঁছেছে। এছাড়া শিঙের গোঁড়া মোটা হলে সেটি গরুর পরিপক্বতা ও স্বাস্থ্য নির্দেশ করে। অনেক সময় গরু আকারে বড় দেখালেও দাঁত না উঠলে কিংবা শিঙ চিকন ও লম্বা হলে সেটি কুরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
কুরবানির পশু কেনার সময় শুধুমাত্র বাহ্যিক আকর্ষণ দেখে নয়। বরং সচেতনভাবে পশুর স্বাস্থ্যের লক্ষণ-উপলক্ষণ বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা বা অসুস্থ পশু থেকে দূরে থেকে একটি সুস্থ, নিরাপদ ও শরিয়তসম্মত পশু কুরবানি দিন। যাতে আপনার ইবাদত হয় খাঁটি, আর ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায় ।