আল জাজিরার বিশ্লেষণ
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের উদারতার চাদর গায়ে দিতে চায় বিএনপি
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:০১ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:২০ PM
বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দীর্ঘদিনের মিত্র শীর্ষস্থানীয় ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী। তবে তাদের মধ্যে বহু দশকের এ জোট পুরোপুরি ভেঙে যাচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের একটি উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে পুনঃস্থাপিত করতেই এমন পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের ১৬ মাস পর এমন অবস্থান নিয়েছে বিএনপি।
মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, সমালোচক ও বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার এবং ২০২৪ সালের আগস্টে বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নসহ নানা কারণে তার দেড় দশকের শাসন থেকে সরিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
দীর্ঘদিন ধরে দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তি হিসেবে দাবি করে এসেছে। যদিও সমালোচকেরা সে দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অপরদিকে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতার ভিত্তিতে।
জোট হলেও দল দুটির আদর্শগত পার্থক্য কখনোই গোপন ছিল না। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী দল বিএনপি। আর দেশের অধিকাংশ মানুষের ইসলামী পরিচয়ই মূল অস্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয় জামায়াতের। সেই পার্থক্যই এখন স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ বিচ্ছেদে রূপ নিয়েছে। যদিও দুই দলই ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের অংশীদার ছিল।
চলতি সপ্তাহে দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘মানুষ দেখেছে তখন কী ঘটেছিল।’ যদিও তিনি তার বক্তব্যে জামায়াতের নাম উল্লেখ করেননি। তবে ইঙ্গিতটি কাদের দিকে, তা সবাই বুঝতে পেরেছেন। মহান স্বাধীনতার সময় জামায়াতে ইসলামী বিরোধিতা করেছিল বলে দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী দল বিএনপি। আর দেশের অধিকাংশ মানুষের ইসলামী পরিচয়ই মূল অস্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয় জামায়াতের। সেই পার্থক্যই এখন স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ বিচ্ছেদে রূপ নিয়েছে। যদিও দুই দলই ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের অংশীদার ছিল।
জামায়াত ধর্মকে অপব্যবহার করে ভোট চাইছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারেক রহমান। এর আগে গত মাসে একই ধরনের মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দেশে ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করা উচিত নয়। জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক নীতি এবং ১৯৭১-এর মূল চেতনার ভিত্তির ওপর ভিত্তি করে বিএনপির রাজনীতি দাঁড়ানো উচিত বলেও মত তার।
এই পরিবর্তনের পেছনের কারণ কী?
বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তব্য ও অবস্থান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, তারা সেই ভৌগোলিক অঞ্চলটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়, যেটি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ দখলে রেখেছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার একপাক্ষিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ও পুনর্লিখন করে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ধাবিত করার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার কারণে তাকে দায়ী করা হয়।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে সেই মতাদর্শকেই এগিয়ে নিয়েছিলেন। এ সময়ে তিনি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেন এবং বিএনপির হাজারো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। এর মধ্যে ছিলেন বিএনপির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বর্তমানে হাসপাতালে ‘অত্যন্ত সংকটজনক’ অবস্থায় ভর্তি আছেন বলে জানিয়েছে দলটি।
রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের ওপর হাসিনা সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। দমন-নিপীড়নের মধ্যেই এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে বিজয়ী হয়েছিল।
বাংলাদেশে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সামনে একটি অপ্রত্যাশিত সুযোগ এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফাঁকা স্থান দখল করার সুযোগ পাচ্ছে তারা, যা আগে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ করতো। এজন্যই বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, যাদের ঐতিহাসিক সংযোগ বিএনপির বহুমাত্রিক রাজনীতিকে সমর্থন করা ভোটারদের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত।
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সামনে একটি অপ্রত্যাশিত সুযোগ এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফাঁকা স্থান দখল করার সুযোগ পাচ্ছে তারা, যা আগে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ করতো। এজন্যই বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, যাদের ঐতিহাসিক সংযোগ বিএনপির বহুমাত্রিক রাজনীতিকে সমর্থন করা ভোটারদের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত।
এই বিচ্ছেন হঠাৎ ঘটেনি। কয়েক মাস ধরে তাদের মূলনীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। নির্বাচনের আগে বিস্তৃত সংস্কার প্রয়োজন কিনা, সংবিধান পুনর্গঠন ও হাসিনা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক মডেল কেমন হবে, তা নিয়ে। জামায়াত ভোটের আগে কাঠামোগত সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেখানে তৎক্ষণাৎ নির্বাচন ও সংবিধানে সীমিত পরিবর্তনের পক্ষে ছিল বিএনপি। এই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্যে আনে।
কৌশলগত কারণে নয়, এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় মতাদর্শগত পুনঃসমন্বয়ও প্রতিফলিত করে। সেন্টার-লেফট ও লিবারেল-ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির স্থান এখন শূন্য। ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের আগে এ জায়গাটিতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা সুযোগ দেখছে বিএনপি। ২০২৪ সালের তরুণ- যুবাদের নেতৃত্বে আন্দোলন, একদলীয় স্বৈরশাসনের পতন এবং শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের জাগরণ নতুন গণতান্ত্রিক ও মধ্যপন্থী রাজনীতির চাহিদা বাড়িয়েছে।
বিএনপি মনে করে, জামায়াতের ধর্মনির্ভর অবস্থান এ চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তাদের থেকে দূরে সরে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারবে বলে মনে করছে বিএনপি। এই ভোটাররা আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন ও জামায়াতের ধর্মীয় রক্ষণশীলতার নিয়ে হতাশ। এ পদক্ষেপ ১৯৭১ সালের নৈতিক উচ্চমঞ্চ পুনরুদ্ধারের সুযোগও করে দেবে। বিএনপির লক্ষ্য হচ্ছে, সেই তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করা যারা ১৯৭১ সালকে কোনও এক দলের আনুগত্য নয়, বরং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে।
কৌশলটিতে ঝুঁকিও আছে। বিএনপির এমন অবস্থানকে সত্যিকারের না, ভোটার টাকার কৌশল হিসেবে দেখতে পারে মানুষ। দলের ভিতরে কিছু অংশ এই লিবারেল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয়ের দিকে পরিবর্তনে আপত্তিও জানাতে পারে। লিবারেল-সেন্ট্রিস্ট ভোটের জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র, কারণ যুব-নেতৃত্বাধীন দল এবং নাগরিক সমাজের নেটওয়ার্কও এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ভোটের বিভাজন তাদের সুবিধাজনক অবস্থান কমাতে পারে, যদি তারা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ভোটারদের এক কাতারে আনতে না পারে।
আর সফল হলে বিএনপির এই রূপান্তর গভীর মতাদর্শগত পরিবর্তন আনবে। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে কেন্দ্র-ডান প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং বিস্তৃত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হবে; যা ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ভোটার, শহুরে লিবারেল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও রাজনীতি নিয়ে সচেতন তরুণদেরকে আকৃষ্ট করবে। এর ফলাফল নির্ভর করবে দলের ধারাবাহিকতা এবং জনগণকে বিশ্বাস করাতে পারার ওপর; যা জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে হবে।
২০২৫ সালে বিএনপির নেতৃত্ব নতুন অন্তর্ভুক্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের ভাষায় কথা বলছে। জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ও আওয়ামী লীগ যে ঐতিহাসিক স্থান দখল করেছিল, সেখানে পদার্পণ করে,বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে পুনর্গঠন করছে দলটি। এই পরিবর্তন স্থায়ী হলে ১৯৯০-এর দশকের পর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস হতে পারে। যেকানে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে লিবারেল গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান রক্ষক হয়ে উঠবে তারা। [আল-জাজিরা থেকে অনূদিত]