ডাকসুতে ছাত্রসংগঠনগুলোর চ্যালেঞ্জ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা

আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে নামা আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর বাইরে থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান তাঁরা। সেক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মঞ্চ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে তারা প্যানেল ঘোষণা করবেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে অচল থাকা ডাকসু নির্বাচনের ভোট অনেকটা হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে চলে এসেছে। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি কাঠামো ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যেই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষার চিন্তায় ডাকসু গঠিত, সেই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব এত অল্প সময়ে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সাম্প্রতিককালে ছাত্র-তরুণদের কয়েকটি দাবি আদায়ে সক্রিয় থাকা কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সংগঠকরা শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করতে বা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হবেন। তাদের একটি মঞ্চও ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে চলা ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কেননা ভোটের জয়-পরাজয় শুধু দলীয় নেতাকর্মী নয়, সব শিক্ষার্থী-ভোটারদের ভোটের উপরই নির্ভর করবে। 

কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ বেশ কিছু ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে জনপ্রিয়তা অর্জন করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। তবে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনকে ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা কিভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। অনেক শিক্ষার্থী মনে করছেন, ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে না থাকা এবং বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর শিক্ষার্থীদের সমর্থন আগের মতো না থাকায় একটি শূন্যতা এমনিতেই রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন ছাত্রলীগের হল এবং বিভাগ পর্যায়ে কমিটি থাকলেও সেগুলো এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। হল কমিটিগুলো অপেক্ষাকৃত বেশী সক্রিয় থাকলেও আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের উপর শিক্ষার্থীদের আস্থা থাকে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ক্ষোভ রয়েছে। ডাকসু বা হল ছাত্র সংসদে ছাত্রছাত্রীরা সহমর্মী কাউকেই নেতা হিসেবে চাইবেন। নেতৃত্বগুণ এবং সহমর্মিতা থাকা এমন নেতৃত্ব কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা হলে ক্রীড়া, রক্তদাতা বা বিতর্ক সংগঠনগুলো থেকেও উঠে আসতে পারে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিতে ইতোমধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তবে অবস্থা বিবেচনায় অন্য কোন ছাত্র সংগঠনের সাথে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। 

কোটা আন্দোলনের অন্যতম নেতা নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কাজ করেছি। এজন্য আমাদের বারবার হামলার শিকার হতে হয়েছে। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তাই আমরা আশা করছি ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা আমাদেরই বেছে নেবে।’

আন্দোলনের আরেক নেতা রাশেদ খান বলেন, ‘ডাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের অন্যতম বড় প্লাটফর্ম। আমরা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছি তাই আমরা মনে করছি ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা আমাদেরই ভোট দিবে।’ 

যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান এ বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিতে পারে। এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের কোন বাধা নেই। আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে দেখেছি তারা ডাকসু নির্বাচনে আমাদেরকেই চায়। এজন্য আমরা নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরিবেশ পরিস্থিতি যদি ভালো থাকে আমরা আশা করব সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদেরকেই ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী করবে।’

তবে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মে অরাজনৈতিক শক্তি কোটা আন্দোলনকারীদের চ্যালেঞ্জ মনে করছে না ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এ বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কোটা আন্দোলন ছিলো একটি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন যা শিক্ষার্থীরা সমর্থন করেছে। ডাকসু রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর বিষয়। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার নেশায় মেতে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দেশের সৃষ্টি থেকে শুরু করে ডাকসুর একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। আর ছাত্রলীগ এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই রাজনীতি সচেতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রলীগকেই বেচে নিবে। ছাত্রলীগের বিজয়ে কোটা আন্দোলনকারীসহ অন্য কেউ চ্যালেঞ্জ হবে না।’

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করছেন, গত তিন দশকে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। এখনকার ডাকসুর আবেদন ও দাবি আগেকার ডাকসুর আবেদন-দাবির মত নাও হতে পারে। ভেতর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেকটা বদলে গেছে। এখন সবার আগে দরকার মূল্যবোধ ও সহমর্মিতার পরিবেশ। শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ। রাজনৈতিক শক্তির বাইরে থেকেও একটি শক্তিশালী কন্ঠস্বর ক্যাম্পাসগুলোতে দরকার। সেক্ষেত্রে কোটা সংস্কার মঞ্চ কিংবা অন্য কোনো মঞ্চ থেকেও নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে। কিন্তু ২৭ বছর ধরে অচল থাকা ডাকসুর নতুন নেতৃত্ব গঠনে ভোটের সময় কম। সেক্ষেত্রে যিনি যত দ্রুত গুছিয়ে উঠবেন তিনি তত দ্রুত এবং বেশী সমর্থন আদায়ে সক্ষম হবেন। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র কবি আলীম হায়দার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে দ্রুতগতিতে ডাকসু নির্বাচনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিনিধি সেট করে তারপর প্রচারণার টাইমই পাবে না। সেই স্কোপ (সময়-সুযোগ) রাখা হলো না। শুধু সংগঠন না, শিক্ষার্থীদের অলটারনেটিভ প্লাটফর্ম র‌্যানডম পদ্ধতিতে হলেও অন্তত দশ শতাংশ শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতো। এতে ডাকসুর গুরুত্ব বাড়তো বৈ কমতো না। নেতৃত্বের বিকাশে এই ভোট কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা জানি না! কারণ গতানুগতিক নেতৃত্ব নির্ধারণের যে ইয়েস বস স্টাইলের ধারা চলে আসছে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে, ঠিক সেই প্রক্রিয়াতেই সেই দলগুলোর মধ্য থেকেই হয়তো ডাকসুর পদগুলো ভরানোর একটা রাস্তা খোলা হলো— ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণার মাধ্যমে। 

তারপরও যাদের সদিচ্ছা আছে, তাদের নির্বাচনে আসা উচিত। উদ্দেশ্য মহান হলে দশ-বারো জনের মধ্যে থেকেও পরিষ্কার মাথার নেতার জন্ম হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নেতৃত্ব চর্চার ধারাবাহিক ও সিস্টেমেটিক প্লাটফর্ম যেহেতু নেই, তাই যাদের ভেতরে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা আছে, তাদের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করা ও নেতৃত্বগুণ সৃষ্টির চেষ্টা থাকা উচিত।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী রাজিয়া ‍সুলতানা জেরিন বলেন, ভারতের আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ধরণ, ধারা ও মাত্রার সাথে আমাদের দেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের তুলনা চলে না। তবে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর বিদ্যমান অচলায়তন, ব্যবস্থাপনাগত ভুল এবং দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে তরুণদের কণ্ঠস্বর সবচেয়ে বেশি জোরেশোরে শোনা যায় কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনে। এই আন্দোলনগুলোতে জড়িত থাকা কেউ যদি ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন তবে শিক্ষার্থীদের সমর্থন ও সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে তিনি পাস করে যেতে পারেন। তাঁরা জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলোকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন। 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence