বেতন-বোনাসহীন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন

 ডক্টর মো. মাহমুদুল হাছান
ডক্টর মো. মাহমুদুল হাছান  © টিডিসি ফটো

শিক্ষকদের অধিকার নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখাই আমাদের চোখে পড়ে। লেখকদের অধিকাংশ লেখা পড়লে মনে হয় যেন শিক্ষক বলতে তারা শুধু সরকারি শিক্ষকদেরকেই বুঝিয়েছেন আর বেসরকারি শিক্ষক বলতে শুধু এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) অধিভুক্ত শিক্ষকদের বুঝিয়েছেন। বাস্তবিক অর্থে সরকারি শিক্ষক হলো তাঁরাই যারা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষালয় তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যে কোন স্তরেই শিক্ষকতা করেন এবং সম্পূর্ণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেতন-ভাতা উপভোগ করে থাকেন। আর এদের বাইরে যারা এমপিও-এর আওতায় সরকারের বিশেষ অনুদানে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন তাঁদেরকে সাধারণত বেসরকারি শিক্ষক হিসেবে মনে করা হলেও এরা আসলে বেসরকারি নয়, অনেকটাই সরকারি এবং এ সকল শিক্ষকদেরকে অনেকে আধা-সরকারি বা এমপিও শিক্ষকও বলে থাকেন। কোনভাবেই তারা প্রাইভেট বা বেসরকারি নন।

তাহলে বুঝা গেল, উপরে কোন ক্যাটাগরির শিক্ষকই বেসরকারি শিক্ষক নন। মূলত বেসরকারি শিক্ষক বলতে ঐ সকল শিক্ষককে বোঝানো হয় যারা সম্পূর্ণ ব্যক্তি বা সংস্থাধীন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে থাকেন এবং তাদের বেতন-ভাতা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ইনকাম থেকে প্রদান করা হয়। সকল প্রতিষ্ঠানের ইনকাম শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, ভর্তি ফি, সেশন চার্জ ও পরীক্ষার ফিসহ অন্যান্য ফি থেকে উপার্জিত হয়ে থাকে। তাদেরকে প্রাইভেট শিক্ষকও বলা হয়। আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়ও আজ বেসরকারি বা প্রাইভেট শিক্ষকদের নিয়ে।

‘শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর কিংবা শিক্ষক প্রকৃত মানুষ তৈরির সুনিপুণ মিস্ত্রি’- কথাগুলো পাবলিক আলোচনায়, জন সমাবেশে, আড্ডাখানায়, সালিশ-বিচারে, মোটভেশন সেশনে তথা উদাহরণ-উপমায় আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি। শিক্ষকদের নিয়ে কোন কথা উঠলেই মুখে মুখে সম্মানের সাথেই বলা হয়, শিক্ষকতো আমাদের সন্তানদের মানুষ বানানোর নিয়ামক শক্তি, মাতা-পিতার পরেই তাদের অবস্থান, তারা সকলেই সম্মানের পাত্র, তাদের সম্মান না করলে মানুষ হওয়া যায়না ইত্যাদি আরো কত কথা। যে যে ভাবেই বলুক না কেন কথাগুলো কিন্তু অর্থবহ ও খুবই বাস্তব। কিন্তু সামাজিকভাবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা কি তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারছি?

সম্মান প্রদর্শনের বেলায় শিক্ষকদেরকে আমরা অনেক উচ্চাসীন করে থাকি, কিন্তু তাদের সার্বিক অবস্থা কি আমরা কখনো মূল্যায়ন করে থাকি? সম্মানজনকভাবে তাদের অধিকার কি আদায় করতে পারি? তারা ক'জন অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারছে? তাদের আয়-রোজগার দিয়ে কি আদৌ তাদের সংসার চলছে বা সামাজিকভাবেই কি তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে? এসব অনেক প্রশ্ন এখন শিক্ষকদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এর বাস্তব উদাহরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে কোভিড-১৯ এর এ ক্রান্তিকালে।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্বে এখন মহাসংকট চলছে। বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এ মহামারির ক্ষতিকর প্রভাব এখানে অত্যন্ত প্রকট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটি হয়েছে আরো ভয়াবহ, যা জাতির জন্য বয়ে এনেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। গত ১৭ মার্চ ২০২০ সাল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ লাগাতার লকডাউনের আওতায় থাকায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে যেমন হতাশা ও দুশ্চিন্তার কালো আঁধার নেমে এসেছে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে তেমনি নেমে এসেছে দুর্বিসহ জীবনের জীর্ণশীর্ণ অবস্থার করাল গ্রাস। সরকারি, এমপিও বা স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেহেতু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত, সেহেতু এ মহাসংকটে তাদের তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি, বরং তারা ঘরে বসে নাম মাত্র শ্রম দিয়ে সরকারি বেতন-ভাতা নিয়ে আরাম-আয়েশে সুন্দরভাবেই জীবন যাপন করছেন। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় যা দেখার যেন কেউ নেই। বছরাধিক কাল ধরে প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ থাকায় অনেকেতো চাকরি হারিয়েছেন, আবার যারা অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাদানের কাজ করছেন তারা উপযুক্ত বেতনও পাচ্ছেন না।

অথচ বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা বিচারে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনবল অনেক বেশি যা মোট জনবলের প্রায় ৮৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে, সরকারি ও এম পি ও অধিভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা অনেক সীমিত। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায় যে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫৫ হাজারেরও বেশি বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় পৌনে ১০ হাজার এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৫টি এবং মেডিকেল, ডেন্টাল, কওমি মাদ্রাসাতো আছেই আরো হাজারে হাজার। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোয় রয়েছে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী, কারিগরি প্রতিষ্ঠানে জনবল আছে প্রায় আড়াই লাখ। বেসরকারি ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আছে আরও অন্তত ৯০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। আর ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ৩২ হাজার। এছাড়াও বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত ৪ শতাধিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজারেরও বেশি। সব মিলে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে।

অন্যদিকে যদি দেশের ভিন্ন ধারার আরেকটি শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ধরি তা হলো কওমি মাদ্রাসা, যেখানে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল, প্যারামেডিক্যাল, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ যুক্ত করলে এদের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ্য ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবদান অনেক অনেক বেশি। দেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যার তুলনায় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম থাকায় এবং যা আছে তাদের শিক্ষার মান তেমন উন্নত না হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর শিক্ষার্থী ও গার্ডিয়ানদের নির্ভর করতে হয় অনেক বেশি। উল্লেখ্য যে, দক্ষ প্রশাসক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সরকারিভাবে পরিচালিত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান বেশ ভালো রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

চলমান করোনাকালীন এ মহাসংকটে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মানবেতর জীবন যাপন সত্যিই বেদনাদায়ক, যা শিক্ষা ধারায় চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে যে ব্যাপারে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতার সংস্থান হয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিষ্ঠানের ভবনের ভাড়া, বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের বিল পরিশোধসহ অন্যান্য খরচও তারা এই অর্থ থেকে পরিশোধ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় বন্ধ আছে। এই দুর্যোগের মধ্যে ফি আদায়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে ঢাকা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি সংস্থাগুলোও। ফলে, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও যথাসময়ে টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় এই ১১ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাদের বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। বেতনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ তাদের প্রাইভেট-টিউশনিও, যা ছিলো তাদের অনেকের বেঁচে থাকার আরেকটি বিকল্প উপায়। ফলে তাদের পরিবারে এখন দিশেহারা অবস্থা এবং দিনাতিপাত করতে হচ্ছে এক শোচনীয় পরিস্থিতিতে।

সব থেকে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, করোনার এ দোহাই দিয়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও বেশ সুযোগ গ্রহণ করছে। তারা ইনকাম নেই বা কম উপার্জন বলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ কেউ আবার অনেক কর্মজীবীদেরকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছে, আবার কেউ কেউ আংশিক বেতন প্রদান করছেন, তাও আবার প্রতি মাসে নয়, এমনকি এমনও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে কর্তৃপক্ষ শিক্ষক বা কর্মচারীদের চাকরিতে বহাল রেখে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কি নির্মম এ কর্ম! সারা বছর যারা কাজ করলেন নিবেদিত মনে, তাদের এখন বেতন বন্ধ, কখনো বা আংশিক, আবার কখনোবা চাকরিই নেই! তাহলে সারা জীবন কি কোম্পানি কোন সঞ্চয় করেনি তাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের শ্রম নিয়ে? তাদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বেতন-ভাতা প্রদান করলে কি বড় রকমের কোন ক্ষতি হতো? তাহলে অন্তত এ সকল খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাদের পরিবারের মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দিতে পারতো! এ দিকে আবার এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা সারা বছর এক আধটুকু বেতন দিয়েছে, কিন্তু অন্যান্য ভাতা থেকে শিক্ষকদেরকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেছে, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানও এহেন জঘন্য কাজ করেছে।

পরিচয়ে যেহেতু তারা বেসরকারি, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কোন সহানুভুতিতো নেই। বরং শিক্ষা ধারা চালিয়ে নিতে তাদের পক্ষ থেকে রয়েছে নানা উপদেশ। করোনাকালে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সেবা নিশ্চিত করা বেশি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র এ সকল বেসরকারি শিক্ষক কর্মকর্তাদের দ্বারা। একদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখা এবং অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বাড়তি প্রেসারের ফলে তাদের চাকরি হারানোর ভয়ে অনলাইনে শতভাগ নিশ্চিত করতে হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। অথচ এ অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করতে যে অর্থের অতিরিক্ত ব্যয় তার জন্য বাড়তি কোন ভাতাও প্রদান করা হয় না। অপরদিকে অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে নাম মাত্র কিছু এসাইনমেন্ট, ভিডিও, সামান্য পরিসরে কয়েকটি জুম ক্লাস নিয়ে থাকলেও মাস শেষে তারা বেতন-ভাতা শতভাগই পাচ্ছেন এবং আরামেই তাদের সংসার কর্ম চালিয়ে যেতে পারছেন। আমি তাদের অবশ্যই প্রশংসা করি। কিন্তু, একই সিলেবাসে একই বিদ্যা প্রদানের পেশায় কাজ করে এরকম বৈষম্যমূলক নীতি বা আচরণতো আর দেখতে ভালো লাগে না। এটি সত্যিই দুঃখজনক।

তাহলে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ দুঃখ-দুর্দশা ঘন শোচনীয় পরিস্থিতি দেখার কেউই কি নেই? সরকারের উচ্চ মহল বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে মানবিকতার উপমা সৃষ্টি করার কেউ নেই? করোনার প্রথম ঢেউয়ে বিভিন্ন স্তরের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করলেও তা ছিলো খুবই নগণ্য। সরকারের দেয়া এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিলো মাত্র ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা, যা শুধুমাত্র ৮০ হাজার ৭৪৭ শিক্ষক ও ২৫ হাজার ৩৮ কর্মচারীর মধ্যে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছিলো। সম্প্রতি আবারো সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ দিতে সরকারের উচ্চ মহল থেকে একটি আশ্বাসের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ বেসরকারি শিক্ষকের জন্য এ অর্থ কতটুকু আশা মেটাবে তা ভাবার বিষয়।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের এ অর্থ সংকটের মধ্যেই কেটে গেলো গত বারের মুসলমানদের দুটি ঈদ এবং অমুসলিমদের অন্যান্য উৎসব-অনুষ্ঠানসমূহ।

এবারওতো ঈদের আমেজ শুরু হয়েছে, কেউ কি ভেবেছেন, কিভাবে কাটবে বেসরকারি এ বৃহদাংশের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঈদ? করোনার ২য় ওয়েভে শিক্ষক কর্মচারীদের অবস্থা আরো নাজুক, তারা ভেবেছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে নিয়মিত বেতন পাবেন, আগেরমত টিউশনি করে অর্থ উপার্জন করে ভালোভাবে সংসার চালিয়ে সকলের মুখে হাসি ফুটাবেন, তা আর হলো না। আবার নেমে এলো নিরানন্দের ঘোর অমানিশা। এবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা আরো কঠোর, অতিরিক্ত কোন ভাতা ও বোনাসতো নাই, বেতন প্রদানেও রয়েছে তাদের নানা তালবাহানা। তবে বেসরকারিভাবে পরিচালিত কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তুলনামূলকভাবে অনেক উদার ও মানবিক। তারা লকডাউনের মধ্যেও চেষ্টা করে গেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে বেতন-ভাতা দিয়ে সাহায্য করতে। আমরা অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে পারি। কিন্তু এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ শতাংশেরও অনেক কম। বাকী শিক্ষা পেশার সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষের কি মানবেতর জীবন-যাপন, সেটি কি তাহলে দেখার কেউ নেই?!

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর যারা এ শিক্ষা পেশার সাথে জড়িত তারা শিক্ষক; তারা মেরুদণ্ডকে সুস্থ ও সবল করার প্রধান বিধায়ক। সুতরাং শিক্ষক ও শিক্ষা পেশার সাথে যারা জড়িত, তারা যদি হয় অবহেলিত এবং অবমূল্যায়িত, তাহলে তাদের দিয়ে সু সেবা কতটুকু নিশ্চিত করা যেতে পারে তা আসলেই ভাবার বিষয়। একই সমাজে বাস করে এবং একই সেবায় নিয়োজিত থেকে যদি বেসরকারি শিক্ষক সম্প্রদায় বেতন বৈষম্যের শিকার হন এবং প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবন-যাপন করে থাকেন, তাহলে একদিন হয়ত শিক্ষিত মেধাবী ছেলে মেয়েরা শিক্ষকতার এ মহান পেশা থেকে দূরে সরে যাবে এবং এ পেশায় কাজ করার আগ্রহই হারিয়ে ফেলবে। তখন জাতির মেরুদণ্ড হবে দুর্বল এবং জাতি হবে বিকলাঙ্গ। ইতোমধ্যে, পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পেরেছি যে, অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী ক্ষুধা মেটাতে ফুটপাতে ব্যবসায় নেমে পড়েছে অনেকে অর্থাভাবে চরম দুর্দশায় কালাতিপাত করছে। সুতরাং শিক্ষক ও শিক্ষা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তির নিরাপদ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য সর্বশ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। কোভিড-১৯ এর এমন মহা সংকটকালে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুদান প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল সত্যিই কাম্য। সরকার বা প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারক মহল এসকল সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে, আর তাহলে কে আছেন যারা শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ সীমাহীন কষ্ট ও মানবেতর জীবন যাপনের দিকে দৃষ্টি দিবেন?! শিক্ষক সুখে থাকলে জাতি হবে সুশিক্ষিত আর সুশিক্ষাই হলো আদর্শ জাতি গঠনের অন্যতম নেয়ামক।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষা গবেষক ও প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা।


সর্বশেষ সংবাদ