বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় গণিত না থাকলে প্রার্থীর মেধা যাচাইয়ে ঘাটতি থাকবে

সরকারি কর্ম কমিশন
সরকারি কর্ম কমিশন  © ফাইল ছবি

‘বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় গণিত বাদ দেওয়ার সুপারিশ’ শিরোনামে খবরে লেখা হয়েছে, বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস পরিবর্তন করে ছয়টি আবশ্যিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে পরীক্ষার নম্বর পুনর্বণ্টন করে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা' বিষয় সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

সুপারিশে আরো যা বলা হয়েছে:

সাধারণ ক্যাডারের জন্য-
• বাংলা বিষয়ে ২০০ নম্বরের মধ্যে ‘বাংলা রচনায়’ ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ। 

• ইংরেজি বিষয়ে ২০০ নম্বরের পরিবর্তে ‘ইংরেজি রচনায়’ ১০০ নম্বর, ‘ইংরেজি কম্পোজিশনে ও প্রিসিসে (Precis)’ এ ১০০ নম্বর। অর্থাৎ ইংরেজি বিষয়ে মোট ২০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ। 

• বাংলাদেশ বিষয়াবলি বিষয়ে ২০০ নম্বরের মধ্যে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ তে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ। 

• সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ‘সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ ও পরিবেশ, ও ভূগোল’ বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ। 

• আন্তর্জাতিক বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এবিষয়ে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। 

• গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে কোনো সুপারিশ মালা নেই। অর্থাৎ,  এ বিষয়টির কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হয়নি; বরং বিষয়টি বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। 

যাঁরা ‘গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা’ বিষয়টি সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছেন তাঁদের এমন সিদ্ধান্ত নেবার কারণ আমার জানা নেই। যেহেতু কারণ জানতে পারিনি, তাই এটি বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমার মনে হয়।

কারণগুলো নিম্নরূপ হতে পারে:
১. এদেশের সকল শিক্ষার্থীকে বিষয়টিতে দক্ষ বা পরিপক্ব বলে মনে করা হয়েছে। ফলে, উক্ত বিষয়ে মেধা যাচাই করা বা না করার মধ্যে  পার্থক্য নাই বলে তাঁরা সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছেন। 

২. তাঁরা মনে করেছেন যে, শুধুমাত্র গণিতে অনার্স পড়ুয়া বা সংশ্লিষ্ট (যাদের গণিত সহায়ক কোর্স হিসেবে পড়তে হয়) শিক্ষার্থীরাই উক্ত বিষয়ে দক্ষ। ফলে, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় শুধুমাত্র এই সকল শিক্ষার্থীরাই উক্ত বিষয়ে পূর্ণ নম্বর লাভ করার কারণেই চাকরির জন্য মনোনীত হন - যা কাম্য নয়। এর ফলে অন্য শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হয় বলে হয়তো তাঁদের ধারণা। 

৩. অন্য বিষয়গুলোতে দুর্বল হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র গণিতে ভাল নম্বর অর্জন করার ফলে মনোনীত প্রার্থী দ্বারা দেশের সার্বিক উন্নতি অসম্ভব বলে তাঁরা হয়তো মনে করেছেন।

৪. তাঁরা  হয়তো ভেবেছেন - গণিতে দুর্বল হলেও বা দক্ষ না হলেও সিলেবাস সুপারিশ দাতাদের মনোনীত বিষয়গুলোতে দক্ষ হলেই যেকোনো প্রার্থী দেশের সার্বিক উন্নতিতে সর্বোত্তম ভূমিকা রাখতে পারবেন। 

তাঁরা হয়তো আরো অনেক কারণ বিশ্লেষণ করে ‘গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা’ বিষয়ের পরিমার্জন না করে এটিকে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেবার জন্য সুপারিশ করেছেন। বর্ণিত কারণগুলোই যদি সুপারিশ দাতাদের বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে বর্ণিত কারণগুলোর যৌক্তিকতার বিষয়ে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেও এটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

১ নম্বরের উত্তর: এটি একেবারে অসম্ভব, অবাস্তব ও অবান্তর চিন্তা। কারণ, এখনো অনেক  শিক্ষার্থীর মধ্যে গণিত-ভীতি প্রকট আকারে রয়েছে।

২ নম্বরের এর উত্তর: এটি আংশিকভাবে সত্য বলে মনে করা যায়। শুধুমাত্র গণিতে দক্ষ এবং বাকী বিষয়গুলোতে অদক্ষ -এমন প্রার্থীও সম্পূর্ণভাবে যোগ্য হতে পারে না বা যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারবে না। ফলে, তাঁর কাছে থেকে ভালো কাজ আশা করতে পারবো না। একজন প্রার্থীর যদি দেশের সার্বিক বিষয়ে সঠিকভাবে জ্ঞান না থাকে, বাংলা ও  ইংরেজি ভাষায় লিখে প্রকাশ করার দক্ষতা না থাকে - সেক্ষেত্রে, গণিতে দক্ষ হলেও তাঁকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা যাবে না। 

৩ নম্বরের উত্তর: আমার কাছে এই যুক্তি সঠিক বলে মনে হয়।

৪ নম্বরের উত্তর: এই যুক্তিটি সম্পূর্ণভাবেই ভুল বলে আমি মনে করি। 

আরো পড়ুন: বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কবে? 

এবারে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশকৃত সিলেবাসের যৌক্তিকতার বিষয়ে। আমার বিবেচনায় - তাঁদের সুপারিশকৃত সিলেবাসের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, উক্ত বিষয়গুলোতে দক্ষ হলে, দেশের উদ্ভুত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যোগ্যতা অর্জনে অনেকাংশেই সহায়ক ভূমিকা রাখা সম্ভব। তবে, ওগুলোর সাথে গণিতের জ্ঞান বা মেধা না থাকলে বা গণিতে দক্ষ না হলে, উদ্ভুত যেকোনো জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রটি সহজ হবে না। 

কারণ যাঁরা গণিত চর্চা করেন বা গণিতের জ্ঞান যাঁদের মজবুত, প্রতিনিয়ত তাঁদের মেধার বিকাশ ঘটে ও বিশ্লেষণ করার দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং সেইসাথে অভিজ্ঞতা যুক্ত হলে প্রার্থী আরো চৌকস হয়।যদি কোনো প্রার্থী (যাঁর গণিতের জ্ঞান কম) জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন,  তাহলে বুঝতে হবে তাঁর ভিতরে অবশ্যই গণিতের মেধা বা জ্ঞান আছে। তবে এমন প্রার্থীর পাওয়া যাবে স্বল্প সংখ্যাক। কাজেই প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে গণিত বিষয়ের উপর একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেয়া খুবই প্রয়োজন আছে  বলে আমি মনে করি এবং মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। 

উপসংহারে আমার মতামত হলো - বিসিএস পরীক্ষার্থীদের গণিতের জ্ঞান থাকা আবশ্যক এবং এই বিষয়ে তাঁর দক্ষতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। গণিত বিষয়কে শুধুমাত্র নম্বর বেশী পাবার বা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত না করে এটি যে মেধাবৃত্তিক বিশ্লেষণ করার দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করার জন্য দৃঢ় আহবান জানাচ্ছি। সর্বোপরি, গণিত বিষয়কে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত না করলে বা গণিত বিষয়ে মেধা যাচাই না করলে প্রার্থীর মেধা যাচাইয়ে ঘাটতি থেকে যাবে। ফলে, দেশের উন্নতির ধারাকে বাধা গ্রস্ত করবে এবং অদূর ভবিষ্যতে আমাদেরকে সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। 

লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ
            ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ