ক্ষমতায় যাওয়ার পুরাতন প্রকল্প নতুন আলোচনায়
- সাইদুর রহমান
- প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৬ PM , আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১৫ PM

সাবেক ছাত্রদের সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতায় যাওয়ার পুরাতন প্রকল্প নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিকামী রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সহযোগিতায় সেনা-ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়। ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লব ছিনতাইয়ের চক্রান্ত শুরু হয় সেই ৮ আগস্ট ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর থেকে। বিদ্যমান রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা শুরু করে।
সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা প্রায় একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে আসতেন। সরকারের ভাবনা শেয়ার করতেন। ওই উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে এসে বলেছিলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অসংগতি, চাঁদাবাজি বড় আকারে প্রচার-প্রকাশের জন্য। ওই উপদেষ্টার তথ্যমতে, সরকারের পরিকল্পনা ছিল, জামায়াতকে আস্থায় রেখে বিএনপিকে বিতর্কিত করা। এরপর জামায়াতকে টার্গেট করা। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বাহাস শুরু করে দেয়া হয়। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এরপর ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন দল গঠন করা।
পুরাতন ওই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে পেয়েছি, সরকার শুরু থেকেই কৌশলে বিএনপিকে বিতর্কিত করবার চেষ্টা করেছে। গণমাধ্যমগুলোয় বেশি বেশি বিএনপির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচারের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। জামায়াতকে সরকারের পক্ষ থেকে বেশি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। খুলনার কুয়েট বা সিলেটের এমসি কলেজের দু’টি ঘটনা পরিকল্পিত ছিল। কুয়েটের ঘটনায় ছাত্রদলকে ছাত্রলীগের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্যদিকে সিলেটের ঘটনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন একইভাবে রগকাটা শিবির বলে প্রচার চালিয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে দু’টি ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের হাত ছিল। সেই তৃতীয় পক্ষটি ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছাত্রদল-শিবিরকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে ওই পক্ষটি। এরপর গত কয়েকদিন চলা দেশব্যাপী অরাজকতার পেছনেও রয়েছে শক্তিশালী একটি চক্র। দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বকে অকেজো প্রমাণ করে নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে সামনে আনা। সেই দলকে সামনে আনার ক্ষেত্রেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা স্পষ্ট হয়েছে।
দল গঠনের আগ পর্যন্ত সাবেক ছাত্রদের দিয়ে আরো বেশকিছু কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার কথা ছিল। কিন্তু কার্যত সেগুলি ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো-রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করা, গণপরিষদ গঠন করা, বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করা, পরবর্তীতে সেনা প্রধানের অপসারণ করা। কিন্তু প্রথম তিনটি দাবিতে পরাস্ত হওয়ার পর সাবেক ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন প্লাটফর্মটি আবেদন হারাতে শুরু করে। এরপর উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল আনা হয় অন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে।
গত ১৬ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ছোট সংস্কার হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভোট এবং বড় সংস্কার হলে ২০২৬ সালে জুনে ভোটের ঘোষণা দেন। এবার জাতীয় নির্বাচন পেছানোর জন্য টালবাহানা শুরু হয়। প্রথম নির্বাচন সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তোলা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ভুয়া জরিপ পরিচালনা করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে মতামত আনা হয়। স্থানীয় সরকারের ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরউদ্দীন পাটোয়ারী ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়া হবে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানাতে থাকে জামায়াতে ইসলামীও।
নানা দাবিতে আকস্মিক সোচ্চার হওয়া ব্যক্তিরা জানে না যে, দেশে র্বর্তমানে নির্ভুল ভোটার তালিকা নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন ঘোষণা দেন, আগামী জুন মাসে আমরা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা করতে পারবো। বর্তমান যে ভোটার তালিকা আছে সেখানে ১৭ লাখের মতো মৃত্যু ভোটার শনাক্ত হয়েছে। ফলে আগামী জুলাইয়ের আগে দেশে কোনো নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আগে আয়োজনের প্রচেষ্টাও ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের ভেতরে জুলাই-আগস্টের গণবিপ্লবের চেতনা বিরোধী একটি শক্তি বেশ শক্তিশালী। কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় তারা উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেয়েছে সেটিও অদৃশ্য। অথচ জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে সরাসরি জড়িত সমাজের বিশিষ্টজনদের অবহেলা করা হয়েছে। সুবিধা দেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট একটি সিন্ডিকেটকে। ওয়ান ইলেভেন অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি প্রচেষ্টা ছিল প্রথম থেকেই। সেটি এখনো অব্যাহত আছে। শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিন্তু শেখ হাসিনার পতন হয়নি, বরং জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লবটি সংঘটিত হয়েছিলো বিগত সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসন, দুঃশাসন, লুটপাট, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ভোট ডাকাতি, নিপীড়ন, সীমাহীন নির্যাতনের কারণেই। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফ্রন্টলাইনে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে সেটি অস্বীকার করবার ন্যূনতম সুযোগ নেই। কিন্তু এই সামাজিক আন্দোলনটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিকামী রাজনৈতিক দল, জনতা ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর।
১৮ জুলাই ছাত্র সমন্বয়ক আব্দুল কাদের শেখ হাসিনার পদত্যাগ সম্বলিত ৯দফা ঘোষণার পরপরই ১৯ তারিখে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, সহ-সমন্বয়ক হাসিব আল মাহমুদ আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মন্ত্রীর সাথে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় চারঘণ্টা ব্যাপী বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে নতুন করে ৮দফা সম্বলিত দাবি উপস্থাপন করেন। সেই ৮ দফায় কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছিল না। এরপর ডিবি হারুণের হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বিভক্ত আন্দোলনটি ৯দফার ভিত্তিতেই আব্দুল কাদের, বাকের মজুমদার, মাহিনরাই শক্ত অবস্থান নেন। ২১ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান শেখ হাসিনার পতনের একদফার ঘোষণা দেন। কিন্তু ছাত্ররা আবার ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২৯ জুলাই আন্দোলন স্থগিতও করেছিলেন। ১ আগস্ট ৬ সমন্বয়ক মুক্তির পর ৩রা আগস্ট শহীদ মিনার থেকে ৬ আগস্ট মার্চ ফর ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে ছাত্রদের বিভিন্ন মাধ্যমে বেশ কয়েকবার যোগাযোগও হয়। বিএনপি থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো আন্দোলনের বিরতি না দেয়ার জন্য। বিএনপির মহাসচিবের পরামর্শেই ৬ আগস্ট থেকে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই ৫ আগস্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বে সেনা-ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এই গণবিপ্লবের সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেয়া নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আব্দুুল কাদের, বাকের মজুমদার, মাহিনসহ অন্যান্যদের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তারা এখন ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নে রাজনীতিতে বিভক্তির বীজবপন শুরু করেছে। আগামী শুক্রবার নাহিদের নেতৃত্বে দল গঠন করা হবে। বাংলাদেশ সিটিজেন পার্টি (বিসিপি) বা বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (বিএনপি) এই দু’টি নাম নিয়ে ছাত্ররা অগ্রসর হচ্ছে। এই ছাত্রদের টার্গেট বিএনপি। তাদের রাজনৈতিক আদর্শও বিএনপির মতো মধ্যমপন্থী। এই দল গঠনের জন্য সদ্য পদত্যাগকৃত নাহিদ ইসলামকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনরা যেভাবে উচ্ছ্বাস উদ্যাপন করলেন তা রীতিমতো অবাক করার মতো।
স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা নাহিদকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে নতুন দলের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার আপন ভাতিজা অপূর্ব জাহাঙ্গীর। তিনি তার চাচার উপ-প্রেস সচিব। তিনি এক কদম এগিয়ে বলেই দিয়েছেন, আপনি বাজি ধরতে পারেন যে, তিনি (নাহিদ) একদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস-সচিবও নাহিদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা আরেক ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আগামীর যাত্রার জন্য শুভ কামনা করেছেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বা প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা দুইজন প্রভাবশালী ব্যক্তি নাহিদকে নিয়ে যেভাবে পোস্ট করেছেন তাতে কি উনারা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেননি? নাহিদকে প্রশংসাকারীরা নাহিদদের নতুন দল থেকে আগামীতে নির্বাচন করবেন। সেটি আপনারা করেন তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে করতে পারতেন। সরকারের সংশ্লিষ্টদের অভিমত, দৃষ্টিভঙ্গি নতুন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার পরিবর্তে নেতিবাচক ধারণায় জন্ম দিয়েছে। আপনারা যাই করুন, গুপ্ত পথে না করে সোজাসাপ্টা পথে আসুুন। গণতান্ত্রিক বা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হোন। জনগণের কাছে যান, তাদের শান্তিতে থাকবার পরিবেশ আগে তৈরি করে দিন। নির্বাচন ঠেকিয়ে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে দল গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো পরিবেশে অন্তত আপাতত বাংলাদেশে সৃষ্টি হবে না। ডিসিদের দিয়ে ভোটের ফলাফল প্রস্তুত করে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনাও কখনো বাস্তবায়ন হবে না। আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে জনগণ দ্বারা। জনগণ স্বচ্ছ ব্যালটে ভোট দিয়ে পছন্দের জনপ্রতিনিধি দ্বারা সরকার পরিচালিত হওয়ার ঐতিহাসিক পদ্ধতি ফিরে পেতে চায়।
লেখক: রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক