ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩ প্রসঙ্গে

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, উন্নয়ন কাজের অসম বণ্টন, চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চনা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল এদেশের জনগণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে অত্যন্ত বলিষ্ঠ। উন্নয়ন ও শিক্ষার পশ্চাৎপদতার কারণে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে এটিই ছিল স্বাভাবিক। সারা দেশের মানুষ তখন তাকিয়ে থাকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের আন্দোলন দানা বেঁধেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের মনোভাব ছিল অত্যন্ত কঠোর। আইনের যাঁতাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল সরকার। এ লক্ষ্যে তারা তাদের মনের মতো করে ১৯৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন প্রণয়ন করেছিল, যেটাকে কালাকানুন বলে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্র-শিক্ষকরা প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন।

ষাটের দশকের শেষদিকের পাকিস্তানে যখন স্বাধিকারের আন্দোলন দেশব্যাপী তীব্রভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মত প্রকাশের অধিকারকে খর্ব ও শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে পাকিস্তান সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে, একাডেমিক কর্মকাণ্ডকে স্বাধীনভাবে চলতে না দিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রশাসনকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করে সাজায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি প্রচারযন্ত্রের ভূমিকায় রূপান্তরের চেষ্টা করে। এ কারণে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ওসমান গনি এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রবল রোষের কারণ হয়ে ওঠেন। উদাহরণ হিসেবে পণ্ড হয়ে যাওয়া একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কথা উলে­খ করা যায়। যাতে ছাত্ররা মোনেম খানের কাছ থেকে সনদপত্র নিতে এবং শিক্ষকবৃন্দ উপাচার্য ড. ওসমান গণির নেতৃত্বে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখনকার পত্রপত্রিকায় বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায়। তাছাড়া আইয়ুব খানের সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমকে স্বাধীনভাবে চলতে না দেয়া ও রাজনৈতিকভাবে কণ্ঠরোধের একের পর এক উদ্যোগের ফিরিস্তি তো নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছিলই। কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার আন্দোলন দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।

১৯৬৯’র গণ-আন্দোলনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটিও প্রবল হয়। বাধ্য হয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এয়ার ভাইস-মার্শাল আসগর খান পাকিস্তানের দুই অংশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দের বাইরে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আনিসুর রহমান তখন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের দাবির পক্ষে সরকারি পর্যায়ে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ১৯৬২’র কালাকানুনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শিক্ষার গণত য়নের পক্ষে এবং সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার বিপক্ষে সোচ্চার হন। তাঁরা বলেছিলেন, এভাবে শিক্ষাকে সংকুচিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মত প্রকাশের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিকাশ এবং গণতন্ত্রের ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরের কথা বলেন। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি জানান তাঁরা। ১৯৭০ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন।

এভাবে ১৯৭০ পর্যন্ত ৬-দফা ও ১১-দফার আন্দোলনে এবং তৎপরবর্তী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পাশাপাশি অবস্থানেই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন দাবি। ১৯৭২ সালের সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ১৯৭৩ সালের শুরুতে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সমিতিসমূহ ও শিক্ষকদের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করেন। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক সমিতি ও সংশ্লিষ্টরা নিজস্ব প্রস্তাব সরকারকে প্রদান করে। এসব প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রশাসনিক দিক থেকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গণতান্ত্রিকভাবে মতামত রাখার সুযোগ প্রদান, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মান উন্নয়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়তা প্রদান করার বিষয়টি উঠে আসে। এসব প্রস্তাব পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইন জারি করা হয়। এই আইনটি ছিল ব্যাপকভাবে গণতান্ত্রিক ও অংশীদারিত্বমূলক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন ঘটায় এটাকে মুক্তিযুদ্ধের ফসল বলেও বিবেচনা করা হতো।

আগে বিভাগের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষককে তাঁর অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হতো। অব্যাহত ও একচ্ছত্রভাবে বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে অনেক বিভাগীয় প্রধানই ন্যায়নিষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটান। প্রায় ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ এবং সু-সহকর্মীসুলভ আচরণ হয়ে যায় ঐচ্ছিক। ফলে একাডেমিক উৎকর্ষতার পরিবেশের বদলে অধিকাংশ বিভাগেই জবাবদিহিতাহীন একনায়কতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। এ পরিস্থিতির প্রধান বলি হন তরুণ শিক্ষকেরা। (তখন এমনও হয়েছে যে বিভাগীয় প্রধানের সাংসারিক বাজার করা বা সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়ে খালি ঘরে বেবি সিটিং-এর কাজটুকুও তরুণ শিক্ষককেই করতে হয়েছে)। ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিয়োগ এবং কার্যক্রম চলত একই ধারায়। অনুষদের ডিন বা হলের প্রাধ্যক্ষদের ক্ষমতা ছিল আরো বেশি; আর সর্বময় ক্ষমতা ছিল উপাচার্যের হাতে। স্বাধীন মত ও মুক্তচিন্তার প্রকাশ ছিল অসম্ভব এবং সরকারী কাজের সঙ্গে সহমত না হওয়া ছিল দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারের সমালোচনা করায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রথিতযশা শিক্ষককে চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার কারণে অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেশের অন্যত্র বা বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হন।

এমন অবস্থায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩’ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ ও শিক্ষকদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। নতুন এ আইনে বিভাগ ও ইনস্টিটিউট পরিচালনার দায়িত্বে উপাচার্য কর্তৃক চেয়ারম্যান/পরিচালক নিয়োগ প্রথা চালু করা হয়। সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক তিন বছরের জন্য এ নিয়োগ পান। মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী বয়োজ্যেষ্ঠকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেয়ার নিয়ম হয়। একাডেমিক কাজের পরিকল্পনা ও অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য বিভাগের সব শিক্ষককে নিয়ে গঠিত ‘একাডেমিক কমিটি’ এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষককে নিয়ে গঠিত হয় ‘সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি’। বিভাগীয় চেয়ারম্যান এসব সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হলে চেয়ারম্যানকে এসব কমিটিতে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা রাখা হয়, এমনকি তাঁকে অভিশংসনের নিয়মও রাখা হয়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার অবসান ঘটে। নির্বাচনের মাধ্যমে ডিন নিয়োগের প্রথা চালু হয়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী সংস্থা সিন্ডিকেটে সব স্তরের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সংস্থা সিনেটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক প্রতিনিধি, প্রাক্তন ছাত্রদের তথা জনগণের প্রতিনিধি, অধিভুক্ত কলেজগুলোর প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি, জাতীয় সংসদের প্রতিনিধি এবং বর্তমান ছাত্রদের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংসদের আদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আলাদা সমিতি গঠন এবং প্রতি বছর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এসব সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্বাহী কমিটিগুলোর সদস্য করা হয়। একাডেমিক কার্যক্রমের নির্বাহী সংস্থা হিসেবে একাডেমিক কাউন্সিলে অনুষদের ডিন এবং বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান/পরিচালক ও সব অধ্যাপকদের পাশাপাশি যাতে তরুণ শিক্ষকদেরও মতের প্রতিফলন ঘটাতে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি রাখার বিধান করা হয়। কোনো শিক্ষার্থীর একাডেমিক অসদাচরণ বা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে স্বচ্ছতার মধ্যে আনার জন্য সব স্তরের প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করা হয়। কারও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি নিয়ে তদন্ত কমিটি এবং অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রেখে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালনার জন্য যা কিছু করার দরকার তার সবই করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য নির্বাহীর মতো উপাচার্যকেও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা হয়।

১৯৭৩ সাল থেকে এই অধ্যাদেশের সুফল আমরা পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা আজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ বা তরুণ শিক্ষক নির্বিশেষে সবাই তাঁদের অধিকারকে সম্মানজনক ভাবে ভোগ করতে পারছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গণতন্ত্রায়নের ফলে আগের চেয়ে এখন শৃঙ্খলা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত এবং এর প্রভাবে একাডেমিক অগ্রগতিও এখন দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও একাডেমিক কর্মকাণ্ডে সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং ছাত্র-শিক্ষক সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়কে সত্যিকার অর্থেই মুক্তবুদ্ধি চর্চার ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের পীঠস্থান হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করতে প্রণীত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দিয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সরকারগুলোর নানা কার্যকলাপ এ গণতান্ত্রিক আইনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিয়োগে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে আবর্তনের প্রথা উঠিয়ে দেয়ার জন্য বারবার সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে; যদিও শিক্ষকদের প্রবল বিরোধিতার মুখে তা কার্যকর হয়নি।

সামরিক সরকারগুলো যখন রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন করে তখন রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাত্র-সংগঠন রাখার বাধ্যবাধকতা দিয়েছিল, তখন আইনগতভাবেই ছাত্র-সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে মুক্তচিন্তার প্রকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব রাখার বিষয়টি ছিল, কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হবে তা ধারণা করা হয়নি। এর ফলে ১৯৭৬ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্রদের অংশগ্রহণ গৌণ হতে থাকে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ডাকসু নির্বাচন নিয়মিতভাবে না হওয়াও এ জন্য দায়ী।

কোনো কোনো মহল ৭৩’র আদেশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মানের অবনতি ঘটছে বলে সমালোচনা করে। কিন্তু এ সমালোচনার সময় আমাদের স্মরণ রাখা উচিত দেশের ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বিপুল চাপের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আসন সংখ্যা প্রতি বছর বাড়িয়েই চলেছে, কিন্তু সে অনুপাতে তার শিক্ষকের সংখ্যা কিংবা শিক্ষা ও আবাসন অবকাঠামো বাড়েনি। ফলে প্রকট সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চলতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও এটি উচ্চশিক্ষার মানের জন্য দেশ-বিদেশে সমাদৃত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগের ঘাটতি নিশ্চয়ই রয়েছে, এটি আমরা লুকোতে চাই না। ঘাটতি না থাকলে আমরা নিশ্চয়ই গবেষণায় আরো ভালো করতে পারতাম। বিজ্ঞান এগিয়ে চলছে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন হচ্ছে নিত্যনতুন গবেষণা সামগ্রী ও অগ্রসর প্রযুক্তির। কিন্তু একটি গরীব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, যার নিজস্ব কোনো আয় নেই, মাসিক বেতন পৃথিবীর সম্ভবত সর্বনিম্ন বলে এ আয় ধর্তব্য নয়, এবং যাকে প্রায় সর্বক্ষণই সরকারি সীমিত অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হয়, তার পক্ষে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গবেষণা অবকাঠামো সৃষ্টি সম্ভব নয়। ফলে বিখ্যাত জার্নালগুলোতে প্রকাশিত গবেষণার হারও আমাদের কম। কিন্তু তার পরেও আমাদের যে পরিমাণ ও মানের গবেষণা নিবন্ধ প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে তা অনুলেখ্য নয়।

সীমিত সম্পদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যা কিছু অবদান রাখছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান। সমাজের প্রতিটি শ্রেণি থেকে আসা শিক্ষার্থীরা স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এ শিক্ষায়তনে আসতে পারছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় নামমাত্র খরচে দেশের শিক্ষিত জনশক্তির বিপুল চাহিদার সিংহভাগ সরবরাহ করে থাকে। পাকিস্তান আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে যে পরিমাণ খরচ করতে হতো, বর্তমানের অনেক গুণ মুদ্রাস্ফীতি ও উচ্চ দ্রব্যমূল্যের সময়েও শিক্ষার্থীর খরচ প্রায় একই আছে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পার্থক্য বিবেচনায় রাখতে হবে।

কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পাকিস্তান আমল থেকে যেভাবে অবহেলিত ছিলেন, এখনো প্রায় সে রকমই আছেন। সমাজ তাঁদেরকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে আসীন করেছে; কিন্তু তাঁদের সম্মানীর বিষয়টি সেভাবে বিবেচনা করেনি। উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ নয়, আমাদের এই সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতিটিতে সেখানকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ আমাদের অধ্যাপকদের চাইতে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশী বেতন পান। অথচ সেসব দেশের একজন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার গড় ব্যয় আমাদের চাইতে অনেক কম, অন্যান্য নাগরিক সুবিধাদিও অনেক বেশি। আমাদের অধ্যাপকবৃন্দ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা আয় করেন তা দিয়ে জীবনধারণে সমস্যা থাকলেও সামাজিক সম্মানের ও ভাবমূর্তির কারণে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেন। বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে তাই বিদেশে চলে যাওয়া কিংবা বিকল্প সৎ রোজগারের কথা ভাবতে হয়। শিক্ষকদের বিশেষায়িত জ্ঞানের কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত হিসেবে ক্লাস নেয়ার কাজ পাওয়া তাঁদের জন্য সমস্যা হয় না। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকই এই অর্থনৈতিক অচলাবস্থা জনিত অতিরিক্ত কাজ থেকে মুক্তি চান। তাঁরা চান এই সময়গুলো কোনো গবেষণায় ব্যয় করতে। গবেষণা অবকাঠামো উন্নত হওয়া চাই। কিন্তু শুধু অবকাঠামো বাড়লেই এখানে গবেষণা বাড়বে তা কষ্টকল্পনা হয়েই থাকবে যতক্ষণ শিক্ষক-গবেষকদের বেতন-সম্মানীকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া না হয়। প্রয়োজন ও প্রাপ্য বেতনের ফারাক যত বেশি হবে, এখানে গবেষণা ও তার মানও ততই কমবে বলে আমার ধারণা।

তবে দীর্ঘ চলি­শ বছর পর ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের আধুনিকীকরণ করার প্রস্তাব আসতেই পারে। তবে তা হবে অভিজ্ঞতার নিরিখে বাস্তবানুগ করে; একপেশে সমালোচকদের মতানুযায়ী একে বাতিল করে নয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত মতামত প্রয়োজন।

উদাহরণ হিসেবে ডিন নির্বাচন বিষয়ক ধারাটি আলোচনায় আনা যেতে পারে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞায় বলতে পারি, যে গণতান্ত্রিক স্পিরিট নিয়ে অনুষদের ডিন নির্বাচিত হওয়ার কথা তখন বলা হয়েছিল, আজ তা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। ডিন নির্বাচন করার নিয়মটি রহিত করে অনুষদের সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে ক্রমান্বয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তিন বছরের জন্য একেকজন উপাচার্য কর্তৃক ডিন মনোনীত হতে পারেন। বিভাগীয় চেয়ারম্যান বা ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা যেমন তিন বছরের জন্য মনোনীত হন, তেমনি ডিনও তিন বছরের জন্য মনোনীত হতে পারেন। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে ডিন আবর্তিত হওয়ার ফলে সবাই কোনো না কোনো সময় ডিন হতে পারবেন। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে অনুষদভিত্তিক তীব্র দলাদলি কমিয়ে আনা, শিক্ষক নিয়োগের সময় অবাঞ্ছিত দলীয় প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা বন্ধ হওয়া প্রভৃতি সম্ভব হবে। তবে সিনেট, সিন্ডিকেট, ফিন্যান্স কমিটি ও একাডেমিক কাউন্সিলে শিক্ষকদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

এ নিবন্ধের যে আলোচনা রাখা হলো তা একান্তই আমার নিজস্ব ও ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসূত, কোনো দলীয় বা গ্রুপের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এর কারণেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি একাডেমিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে পড়েছে এমন বক্তব্য যে সঠিক নয়, তা বুঝাতেই এই দীর্ঘ আলোচনা। আশা করি এর মাধ্যমে যারা অধ্যাদেশটির বিষয়ে সঠিকভাবে অবহিত না হয়ে এর বিরোধিতা করেন তাদের ভ্রান্তি দূর হবে। তবে যারা সচেতনভাবেই বিরোধিতা করেন তারা সম্ভবত চান যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি পাকিস্তান আমলের মতো অরাজক অবস্থায় চলে যাক, বাক-স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা বন্ধ থাকুক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড রুদ্ধ হোক এবং তরুণ সমাজের প্রতিবাদী সংস্কৃতি থেমে যাক। তাদের অনেকে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করেন। কিন্তু তারা ভুলে যান যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি কোনো উন্নত দেশের নয়, এমনকি কোনো উন্নয়নশীল দেশেরও নয়, বরং একটি স্বল্পোন্নত দেশের একটি অসচ্ছল বিশ্ববিদ্যালয়। তারা কখনো বলেন না যে তারা যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করেন সেগুলোতে শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের অনুপাত কত, শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে কত টাকা বেতন দেয়, শিক্ষকরাও কত টাকা মাইনে পান, সেগুলোতে কতজন শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পায়, তার জন্য শিক্ষার্থীকে কত টাকা দিতে হয়, আমাদের মতো হলের একটি সিটে কয়েকজন শিক্ষার্থী সেখানে থাকে কিনা, সেসব দেশে দরিদ্র মানুষদের সন্তানেরা এখানকার মতো ব্যাপক হারে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে পারে কিনা ইত্যাদি। ’৭৩-এর অধ্যাদেশটিকে সব কিছুর জন্য দায়ী করার আগে তারা এসব বিষয় নিয়েও বলবেন আশা করি।

লেখক: সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 


সর্বশেষ সংবাদ