নতুন শিক্ষাক্রমে লাভ হবে ইংরেজি মাধ্যম আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ছবি

খুব বেশি দিন আগের কথা না। ৮০-র দশকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছেলে-মেয়েরা বাংলা মাধ্যমেই পড়তো। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের উদয়ন স্কুল এবং ল্যাবরেটরি স্কুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা পড়তো। তখন এই দুটো স্কুল ছিল ঢাকার সেরা স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। এই দুই স্কুলে পড়া শিক্ষকদের সন্তানদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতো।

৯০-এর পর এরশাদের পতনের পর থেকে এই স্কুলসহ বাংলাদেশের বাংলা মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষার মানের ধস নামে। কেন ধস নামে? সেই সময় আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকাররেরা ক্ষমতায় এসে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব দেন রাজনীতিবিদদের হাতে। আর মাশাল্লাহ আমাদের আমাদের এমপি-মন্ত্রী আর আমলাদের হাতে কোন কিছু গেলে সেগুলোর মান নষ্ট হবেই।

এর আগে স্কুলের প্রধান শিক্ষকই ছিলেন স্কুল পরিচালনার মূল কারিগর। আমরা আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষককেই চিনতাম। ম্যানেজমেন্ট নামে কিছু আছে জানতামই না। কোনদিন দেখিওনি। যখন থেকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্বটা ম্যানেজমেন্ট কমিটির হাতে চলে যায় শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে সব কিছুর মাঝেই দুর্নীতি বড় স্কেলে ঢুকে যায়। তখন থেকে বাংলা মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষকদের ক্ষমতা কমতে থাকে।

আর একই সাথে দেশের মুদ্রাস্ফীতির সাথে শিক্ষকদের বেতনও কমতে থাকে। যখন থেকে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর মান নামতে থাকে ঠিক তখন থেকেই। আর বিকল্প হিসাবে ইংরেজি মাধ্যম জনপ্রিয় হতে থাকে। এরই হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমলা, এমপি-মন্ত্রীর সন্তানেরা দ্রুত ইংরেজি মাধ্যমে যেতে থাকে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ধারার পরিবর্তন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের ধারা বাংলা মাধ্যমের সিলেবাস ও প্রশ্নের সিস্টেম অনুসারে চলতে থাকায় ইংরেজি মাধ্যমের সন্তানেরা কম পেতো। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও ইংরেজি মাধ্যমের উচ্চবিত্তের ছেলে-মেয়েরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইতো না।

ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির একটা ক্ষেত্র তৈরী হয় এবং নর্থ সাউথ নামে তৈরী হয় দেশের প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু ক্ষমতাবানদের ছেলে-মেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়তো তাই  হয় তারা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, না হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে ক্ষমতাবানরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজর ফিরিয়ে নেয়।

ধীরে ধীরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠে আমাদের প্রাথমিক স্কুলের মত গরিবের বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হয়ে উঠে রাজনীতির ঘুটি। তাদের উপর ভর করে ক্ষমতায় যেতে চাওয়া আর ক্ষমতা থেকে কাউকে নামাতে চাওয়া দল। এভাবে বাংলা মাধ্যম হয়ে উঠে গরিবের শিক্ষা।

এর মধ্যে জাতীয় কারিকুলামে পড়তে চাওয়া একটা মধ্যবিত্ত গড়ে উঠে, যারা তাদের সন্তানদের ইংরেজিতে পড়াতে চায়। কারণ আমাদের দেশে ইংরেজি জানাকে জ্ঞানের সাথে সমর্থক বানিয়ে ফেলেছে। ফলে বাংলা মাধ্যমকে ইংরেজিতে করে নতুন একটি অদ্ভুত ধারা তৈরি হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছে ভার্সন। বড় লোকের ছেলে-মেয়েরা হয় ভার্সনে পড়বে না হয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি হিসাবে বড় হতে থাকে। 

এই কারণেই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েদের বিসিএস প্রশাসনে, বিসিএস ট্যাক্স কিংবা পুলিশে অথবা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে দেখা যায় না। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েদের দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও দেখা যায় না। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েদেরকে দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও দেখা যায় না।

ফলে শিক্ষার মাধ্যম অনুসারে দেশের মানুষেরা বিভাজিত হয়ে যায়। যার একটি ধারা মাদ্রাসা, একটি ধারা বাংলা মাধ্যম, একটি ধারা ইংরেজি ভার্সন এবং একটি ধারা ইংরেজি মাধ্যম। রাষ্ট্র এদের কারো সাথে কারো দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার ব্যবস্থা রাখেনি।

নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এই বিভাজন আরো প্রকট হবে। বাংলা মাধ্যম থেকে আরেক দফা একটি গ্রুপ ইংরেজি মাধ্যমে যাবে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনৈতিক পরিবারের সন্তানরা মাদ্রাসায় চলে যাবে। এই ইংরেজি মাধ্যম তো দেশের কাজে তেমন আসে না, মাদ্রসাও দেশ উন্নয়নে তেমন কাজে লাগে না। ফলে দেশ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কিন্তু লাভ হবে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই দুটোই চালায় আমলা মন্ত্রী এমপি বা রাজনৈতিক নেতারা। তবে কি ইচ্ছে করেই নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে?

আজ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মন্ত্রী, আমলা, এমপি, বড় ব্যবসায়ীদের ছেলে-মেয়ে পড়তো তাহলে কি ছাত্রদের রাজনীতির ঘুটি বানাতে পারতো? তাহলে কি এতো কম বাজেট বরাদ্দ দিতে পারতো? তাহলে কি ছাত্র-ছাত্রীরা আবাসিক হলগুলোতে এত অমানবিকভাবে থাকতো?

তাহলে কি শিক্ষক নিয়োগ ও ভিসি প্রো-ভিসি নিয়োগে অযোগ্য ও দলকানাদের খুঁজে বেড়াতো? আলটিমেটলি দেশ তো চালাবে বাংলা মাধ্যমে পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।

এবার ভাবুন নতুন শিক্ষাক্রম দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এত এত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থাকতে সরকার সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে উঠে পরে কেন লাগলো? দেশের নাগরিকদের কোন অংশের কি দাবি ছিল কারিকুলাম বদলানোর? যখন মানুষের দাবি না থাকা সত্ত্বেও সরকার কিছু করে তখন বুঝতে হবে ডালমে কুচ হ্যায়।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ