বাংলাদেশে আঘাত হানা যত ঘূর্ণিঝড়

সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়া বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি নেহাত কম নয়৷ প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়। তবে গত কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে রুদ্র প্রকৃতিকে বাগে আনার সাধ্য মানুষের কোথায়।

কাছাকাছি সময়ে আঘাত হানা সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। ২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত হানা ওই ঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এবার সিডর-র চেয়েও শক্তিশালী আরেক ঘূর্ণিঝড় আঘাত করল বাংলাদেশকে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি এ শতাব্দীর প্রথম ‘সুপার সাইক্লোন’ আমফানের তাণ্ডবে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ণয় করা যায়নি।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানাচ্ছে, ঘুর্ণিঝড় আম্পান এখন পাবনায় অবস্থান করছে। সেখানে ক্ষমতা হারিয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে সুপার সাইক্লোনটি। তবে ইতোমধ্যেই সাইক্লোনটি হাজার হাজার হাজার মানুষকে ঘরবাড়িহীন করে করে ফেলেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে প্রাথমিকভাবে বুধবার পর্যন্ত ১০ জন মারা যাওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমাজের্ন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। তবে এর মধ্যে ছয়জনের পরিচয় জানা গেছে।

তীব্র বাতাস, ভারী বৃষ্টিপাত ও উঁচু জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূলজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সাতক্ষীরা থেকে পটুয়াখালী উপকূল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। বুধবার রাত নয়টায় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার গতিবেগে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত করে। এ সময় ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ছিল।

আগে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হত না। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে ঝড়ের নামকরণের জন্য নিয়ম বানানো হয়। তাতে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া শুরু করে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। সব দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নাম চাওয়া হয়৷ তার থেকে দেশ প্রতি ৮টি করে নাম বাছাই করে মোট ৬৪টি ঝড়ের নামকরণ করা হয়। সেই তালিকার শেষ নাম ‘আমফান’।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আঘাত হানা শক্তিশালী যত ঘূর্ণিঝড়:

১৯৮৮ এর ঘূর্ণিঝড়: ১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার৷ এই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারান।

১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়: ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার। এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়েছিল৷ ঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ২৯-৩০ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে। এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এক কোটির বেশি মানুষ।

১৯৯৭ এর ঘূর্ণিঝড়: ১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশেপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে৷ ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। এরপর আরো কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। তবে সেগুলো বাতাসের গতিবেগ ছিল কম।

ঘূর্ণিঝড় সিডর: ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। যদিও রেডক্রিসেন্টের হিসাব মতে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার৷ উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার৷ সিডর খুলনা ও বরিশাল এলাকায় তাণ্ডব চালায়। সমুদ্র থেকে উঠে আসা ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সব কিছু ভেসে যায়৷।ঝড়ে তিন হাজরের বেশি মানুষ মারা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ৷ উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে যায়৷ সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি অসংখ্য গবাদিপশু ‍মারা যায়।

ঘূর্ণিঝড় আইলা: ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা উপকূলে ২০০৯ ‍সালে ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা'। এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় তিন লাখ মানুষ গৃহহীন হয়।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন: ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। এটির বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার৷ এই ঝড় বাংলাদেশে ১৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।

ঘূর্ণিঝড় কোমেন: ঘূর্ণিঝড় কোমেন ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আঘাত হানে। বাতাসের গতি ছিল ৬৫ কিলোমিটার৷ কোমেনের প্রভাবে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু: রোয়ানু একটি ছোট ঘূর্নিঝড়, যা ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক অঞ্চলে আঘাত হানে। ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির। রোয়ানু-র আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের মৃত্যু হয়।

ঘূর্ণিঝড় মোরা: উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরা ২০১৭ সালের ৩০ মে ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। ঝড়ের তাণ্ডবে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। কক্সবাজারে বিদ্যুৎব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জমির ফসল এবং লবন চাষীদের জমাকৃত লবন নষ্ট হয়ে যায়৷ দুজন নারীসহ তিনজন মারা যায়।

ঘূর্ণিঝড় ফণী: ২০১৯ ‍সালের ৩ মে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে নয় জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল অনেক বেশি। সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: বার বার দিক বদল করে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়। ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন৷ ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা৷ ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও।

স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী যত ঘূর্ণিঝড়:
১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়৷ ঝড়ের প্রভাবে ৫ থেকে ৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়৷ এতে মারা পড়েন প্রায় ১০ হাজার ‍মানুষ।

পরের বছর ১৯৬১ সালের ৯ মে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার৷ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান ওই ঝড়ে।

১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়৷ ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।

১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন৷ সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের। পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়৷ এতে মারা যান ৮৫০ জন।

১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন'। এই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার। এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ৷ চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


সর্বশেষ সংবাদ