বেশি দামে সিগারেট বিক্রিতে ৩৭৮৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

সংবাদ সম্মেলন
সংবাদ সম্মেলন  © সংগৃহীত

প্যাকেটে যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) লেখা থাকে বাজারে তার চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হয়। যেহেতু সিগারেটের এমআরপি’র ওপর শতকরা হারে সরকার রাজস্ব পায়, ফলে এই বর্ধিত মূল্য থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। বর্ধিত মূল্যের পুরোটাই তামাক কোম্পানির পকেটে যাচ্ছে। এভাবে সুকৌশলে তামাক কোম্পানি রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এ বছর যার সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ৩ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। 

আজ বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১টায় অনলাইন মিটিং প্লাটফর্ম জুম-এ ‘তামাক কোম্পানির মূল্য কারসাজি: প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, দেশে সব পণ্য এমআরপি-তে বিক্রি হলেও সিগারেটের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্যাকেটে লেখা দামের চেয়ে শতকরা ৮ থেকে ২১ ভাগ বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হয়েছে। বাজারে যে দামে বিক্রি হচ্ছে সেটি প্যাকেটে লেখা হলে বর্ধিত মূল্য থেকে সরকার ৩ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা রাজস্ব পেতো। সিগারেট কোম্পানিগুলো মূল্য কারসাজি করে এই রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, খুচরা বিক্রেতাদেরকেই কোম্পানি প্রতিনিধির কাছ থেকে প্যাকেটে লেখা মূল্য বা তার চেয়ে বেশি মূল্যে সিগারেট কিনতে হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা এর চেয়ে বেশি মূল্যে ক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। এই দামটিও তামাক কোম্পানি নির্ধারণ করে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) যৌথভাবে “তামাকজাত দ্রব্যের (সিগারেট) খুচরা মূল্যের ওপর জাতীয় বাজেটে মূল্য ও কর হার পরিবর্তনের প্রভাব” শীর্ষক এই গবেষণা পরিচালনা করে। বিগত পাঁচ বছর ধরে প্রতি অর্থবছরে তারা এই গবেষণা করে থাকে।  

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, অতিউচ্চ স্তরের সিগারেটের ২০ শলাকার প্যাকেটে মুদ্রিত খুচরা মূল্য ৩২৪ টাকা হলেও তা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে গড়ে ৩৪৫ টাকায়। উচ্চ স্তরের সিগারেট ২৪০ টাকার পরিবর্তে গড়ে প্রায় ২৫৩ টাকায়, মধ্যম স্তরের সিগারেট ১৪০ টাকার পরিবর্তে ১৫৩ টাকায় এবং নিম্ন স্তরের সিগারেট ১০০ টাকার পরিবর্তে ১১৫ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এভাবে এমআরপির চেয়ে বেশি দামে সিগারেটে বিক্রি করে অতিউচ্চ স্তরে ৫৮৭ কোটি, উচ্চ স্তরে ১৫৫ কোটি, মধ্যম স্তরে ৬৩২ এবং নিম্ন স্তরে ২৪১০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।  গবেষণার জন্য ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহের বিভাগীয় শহর ও একটি করে জেলা শহর মোট ১২টি এলাকা থেকে ৪৮টি খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সবগুলো খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রেই খুচরা শলাকায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি সিগারেট বিক্রি হয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

ওয়েবিনারে বিশেষ আলোচকের বক্তব্যে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি ও বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, আইন অনুযায়ী এমআরপিতেই সিগারেট বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু তামাক কোম্পানি আমাদের দেশে আইন ভঙ্গ করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। গবেষণার ফল বলছে, তামাক কোম্পানি তারা বর্তমানে আরও আগ্রাসী হয়ে আগের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করছে।  ব্যবসা করতে হলে তাদেরকে দেশের আইনকে শ্রদ্ধা করেই করতেই হবে।  আইন লঙ্ঘন করা এসব তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।

জনস্বাস্থ্য নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। তাহলে রাজস্ব ফাঁকির হার কমে আসবে। তামাক কোম্পানিগুলো সব সময় দাম বৃদ্ধিতে আপত্তি জানায়, কারণ তারা সবসময় এমআরপির চেয়ে সিগারেট বিক্রি করে।  খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ হলে এবং বিক্রয়কেন্দ্রগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসলে তামাক কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। অবৈধ ব্যবসা বন্ধে দেশে খোলা তেল বিক্রিতে সরকার যেভাবে কড়াকড়ি করেছে সেভাবে খুচরা শলাকায় সিগারেট বিক্রিও নিষিদ্ধ করা জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ফাঁকি দেয়া এ রাজস্ব অতিদ্রুত তামাক কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনটিটিপির কনভেনর ড. রুমানা হক বিশেষ আলোচকের বক্তব্যে বলেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাকে কর হার ও মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট করারোপ করতে হবে। একইসঙ্গে অতিদ্রুত সরকারকে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে একটি জাতীয় কর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনে, এমআরপিতে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জোরালো মনিটরিংসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ; সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং কর ফাঁকি বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতির প্রচলন; তামাকজাত দ্রব্যের বাজার ও বিক্রয়  পর্যবেক্ষণ ও কর আদায়ে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রচলন; এবং একটি শক্তিশালী তামাক কর নীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়।

ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বিইআরের প্রজেক্ট অফিসার ইব্রাহীম খলিল। গবেষণার ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিইআরের প্রজেক্ট ম্যানেজার হামিদুল ইসলাম হিল্লোল এবং সঞ্চালনা করে বিএনটিটিপি’র গবেষণা সহযোগী ইশরাত জাহান ঐশী।  ওয়েবিনারে জনস্বাস্থ্য ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী অংশ নেন।


সর্বশেষ সংবাদ