পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন মইন ইউ আহমেদ

মইন ইউ আহমেদ
মইন ইউ আহমেদ  © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) মইন ইউ আহমেদ তার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে কথা বলেন তিনি।

ভিডিওর শুরুতেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের নিহতদের মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত সুস্থ কামনা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রার্থনা করে বলেন, সরকার-ছাত্রজনতা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, আমি যখন বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনার তদন্তের আদেশ দিই, তখন আমাকে বলা হয় যে সরকার এই বিষয়ে তদন্ত করছে, তখন আমাদের এর প্রয়োজনটা কী? এই তদন্ত করতে সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য প্রয়োজন, তা আমরা পাইনি।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটনেন্ট জেলারেল জাহাঙ্গীর আলাম চৌধুরী (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা)। তিনি তার কাজ সঠিভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি, কারণ অনেকে জেলে ছিল, অনেককে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি। আমার কাছে এসে বেশ কয়েকবার তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

আমি আশা করি, তিনি এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়েছেন। তিনি এই তদন্ত কমিটি পুনর্গঠিত করে জড়িতদের বের করতে সক্ষম হবেন। আমি সরকার গঠনের পর তাকে এই বিষয়ে অনুরোধ করেছি।

কী ঘটেছিল সেদিন
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, সেদিন (২০০৯ সালের) ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সাড়ে ৭টায় সেনা সদরের প্রতিদিনের মতো কাজ শুরু হয়। সকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল, যেখানে সেনাবাহিনীর পরবর্তী বছরের কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকালে আমি সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সিজিএস লেফটনেন্ট জেলারেল সিনহা আমার কাছে এসে বলেন, আমাদের কাছে কিছু মর্টার আছে, যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এর গুদামজাত ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন। বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে। এগুলো তারা নিয়ে গেলে আমাদের উপকার হবে।

তিনি আরও বলেন, এরপর আমি বিডিআরের ডিজির জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তিনি এগুলো নিতে রাজি হন। আমার বিশ্বাস, তিনি তখন পর্যন্ত এই বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এরপর আমি আর সিজিএস মিটিংয়ের জন্য যাই। ৯টায় সেই মিটিং শুরু হয়। আমারা সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেখানে। সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে প্রবেশ করেন এবং আমাকে বলেন, পিলখানায় গন্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের ফোন ব্যস্ত পাই।

সামরিক গোয়েন্দারা তখন আমাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমি তখন সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়া আরেকটি ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’। এই সম্পর্কে পিএসও এফডি জেনারেল মবিনকে অবহিত করা হয়।

৯টা ৪৭ মিনিটে ডিজি বিডিআরকে ফোনে পাওয়া যায়। তিনি আমাকে জানান, দরবার চলাকালীন দুইজন সশস্ত্র সৈনিক প্রবেশ করে একজন আমার পেছনে দাঁড়ায়। এরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে থাকা সৈনিকরা দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়। এগুলো সবই মনে হয় প্ল্যান করা এবং প্ল্যান অনুযায়ী সব চলছে। আমি সেক্টর কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের পাঠিয়েছি তাদের ফেরত আনার জন্য। তখন আমি তাকে অপারেশনের কথা জানাই।

৯টা ৫৪ মিনিটে আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারি। এর মধ্যেই তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেছিলেন। এ সময় আমি তাকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে এই ব্রিগেডকে তৈরি করতে? আমি সময় জানিয়ে ব্রিগেডকে পিলাখানায় যাওয়ার জন্য তার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় লাগলেও ৪৬ ব্রিগেড এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে। ব্রিগেড কমান্ডারের নেতৃত্বে ১০ জন অফিসার এবং ৬৫৫ জন অফিসার যাত্রা শুরু করেন।

এদিকে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে রকেটলঞ্চার, মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে। বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ করে রকেট হামলা চালায়। এতে চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাদের টিম পৌঁছায় ১১টার পরে।

ঘটনার সময় গণমাধ্যমে চলা লাইভ কাভারেজ বিডিআর বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে বলে সমালোচনা করেন সাবেক এই সেনাপ্রধান।

মইন ইউ আহমেদ জানান, ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র‍্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তিনি তা পাননি। তিনি অনুমতি পেলে হয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুবিধা হতো এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাদের সাথে সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। বেলা ১২টায় তিনি আমাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে বলেন। বেলা ১টার দিকে সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।

তিনি আরও বলেন, আমি যমুনায় যাবারও ঘণ্টাখানেক পর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান সেখানে আসেন। অর্থাৎ তাদের আমার পরে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। অনেকক্ষণ পর তারা সেখানে এলে আমাদের জানানো হয়, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে যমুনায় আসছেন এবং তারা সাধারণ ক্ষমা চায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা যেন তাদের বলি। তখন আমি তাকে বলি, অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোনো দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন প্রথমত, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার প্রশ্নই নেই।

১৪ জন বিদ্রোহী ৩টা ৪৮ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে যমুনায় আসেন। তাদের একটি বড় রুমে রাখা হয়। আমি তখন আমার এডিসি জুনায়েদকে বিদ্রোহীদের নেতাকে নিয়ে আসতে বলি। ডিএডি তৌহিদ যখন আসেন, তখন আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সকাল ৯টায় বিদ্রোহীরা আমাকে একটি রুমে তালা মেরে রাখে। মাত্রই তালা খুলে আমাকে নিয়ে আসা হয়। আমি কিছুই জানি না।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তখন আমি তাকে বলি, আপনি জানেন না, কিন্তু এখানে বাকি যারা আছেন তারা তো জানেন। তাদের গিয়ে জিজ্ঞেসা করেন এবং আমাকে জানান।

ভিডিওতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন মইন ইউ আহমেদ। এ সময় বিডিয়ার বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ