বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি ও গ্রুপিং: শিক্ষার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব

মোহাম্মদ ওমর ফারুক
মোহাম্মদ ওমর ফারুক

বিশ্ববিদ্যালয় হল শিক্ষার পবিত্র স্থান, যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্ন দেখে। শিক্ষার পরিবেশকে সুন্দর ও কার্যকর রাখতে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। কিন্তু যখন শিক্ষকেরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি এবং গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েন, তখন এই পরিবেশ নষ্ট হয়ে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো শিক্ষার্থী যদি একটি নির্দিষ্ট শিক্ষকের পছন্দের তালিকায় না থাকে বা ভিন্নমতের কারণে অবজ্ঞার শিকার হয়, তাহলে তার প্রাপ্য শিক্ষা ও মূল্যায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি তার মেধা অনুযায়ী ফলাফলও নষ্ট হতে পারে।

শিক্ষক রাজনীতি ও গ্রুপিংয়ের কারণ শিক্ষকদের মাঝে রাজনীতি এবং গ্রুপিংয়ের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যক্তিগত স্বার্থ, পদোন্নতি নিয়ে প্রতিযোগিতা, প্রশাসনিক ক্ষমতার লড়াই এবং একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস। এসব কারণে শিক্ষকগণ কখনো কখনো একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, যা তাদের প্রফেশনালিজমকে আঘাত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি এবং গ্রুপিং একটি উদ্বেগজনক বিষয়, যা শিক্ষার পরিবেশ ও মান উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যা শিক্ষকদের আচরণ এবং সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।

নিচে এই সমস্যার মূল কারণগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

১. ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার লড়াই: শিক্ষকরা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ক্ষমতা দখলের আকাঙ্ক্ষায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রশাসনিক পদ বা সুবিধা পাওয়ার লোভ, যেমন: ডিন, চেয়ারম্যান বা প্রক্টর হওয়ার প্রতিযোগিতা, গ্রুপিংয়ের একটি প্রধান কারণ। এই ধরনের ক্ষমতার লড়াই শিক্ষকদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে।

২. রাজনৈতিক প্রভাব: বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জাতীয় রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব ফেলে। শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের আদর্শ অনুসরণ করে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হন। কোনো দলের সমর্থক শিক্ষকরা একত্রিত হয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন।

৩. অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যদি দুর্বল হয় বা পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেয়, তবে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি ও গ্রুপিং বেড়ে যায়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রশাসন না থাকলে শিক্ষকরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গ্রুপ তৈরি করতে বাধ্য হন।

৪. ব্যক্তিত্বের সংঘাত: শিক্ষকদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি বড় কারণ। কোনো শিক্ষক যদি অন্য শিক্ষকের সঙ্গে মতের অমিল অনুভব করেন, তবে সেই শিক্ষক নিজের সমমনা শিক্ষকদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করতে পারেন। এর ফলে বিভক্তি এবং দলাদলি বৃদ্ধি পায়।

৫. কর্মক্ষেত্রে স্বীকৃতির অভাব: যখন কোনো শিক্ষক তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতি পান না বা অবমূল্যায়নের শিকার হন, তখন তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং সমমনা শিক্ষকদের নিয়ে একটি গ্রুপ গড়ে তোলেন। এই অভাববোধ থেকে গ্রুপিং এবং রাজনীতি শুরু হতে পারে।

৬. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাব: অনেক শিক্ষক পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে যথাযথ প্রশিক্ষণ বা নৈতিক শিক্ষার সুযোগ পান না। এর ফলে তাদের মধ্যে সহযোগিতার অভাব দেখা দেয় এবং দলাদলির মনোভাব বাড়ে।

৭. অর্থনৈতিক সুবিধা ও পেশাগত উন্নয়ন: কিছু শিক্ষক প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা আর্থিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করেন। এই ধরনের আচরণ গ্রুপিং এবং রাজনীতির ভিত্তি তৈরি করে।

৮. ছাত্র রাজনীতির প্রভাব: বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তির কারণ হতে পারে। কোনো শিক্ষক যদি নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনকে সমর্থন করেন, তবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষক অন্য দলকে সমর্থন করতে পারেন। এর ফলে ছাত্র রাজনীতির ছায়া শিক্ষকদের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে।

৯. বিদেশি প্রভাব এবং পৃষ্ঠপোষকতা: কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার জন্য শিক্ষকেরা গ্রুপ তৈরি করেন। গবেষণা বা উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থপ্রাপ্তির জন্য একক আধিপত্য বজায় রাখতে এই ধরনের গ্রুপিং দেখা যায়।

১০. বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির অভাব: সুষ্ঠু অ্যাকাডেমিক পরিবেশ এবং পেশাদারিত্বের অভাবে শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ এবং বিভক্তি বাড়ে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং শৃঙ্খলা জোরদার না হয়, তবে এই সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।

শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব
১. আদর্শহীনতা সৃষ্টি: শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের জন্য রোল মডেল। কিন্তু তাদের এই ধরনের আচরণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও নেতিবাচক মানসিকতার জন্ম দেয়।

২. শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট: রাজনীতি এবং গ্রুপিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়। শিক্ষকেরা যখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ কমে যায়।

৩. শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ: শিক্ষক রাজনীতির ফলে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা পক্ষপাতিত্বের শিকার হন। ফলে তাদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং তারা নিজেদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন: শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব এবং রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের ভর্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে প্রভাব ফেলে।

সমাধানের উপায়

১. নৈতিক শিক্ষার প্রচলন: শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত নৈতিকতা এবং প্রফেশনালিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

২. স্বচ্ছ প্রশাসন: প্রশাসনের কাজকর্ম স্বচ্ছ রাখতে হবে, যাতে কেউ অন্যায়ভাবে সুবিধা নিতে না পারে।

৩. মধ্যস্থতা ও আলোচনা: শিক্ষকগণের মধ্যকার সমস্যাগুলি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৪. সুষ্ঠু স্বীকৃতি ব্যবস্থা: শিক্ষকদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন এবং স্বীকৃতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

৫. শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা: শিক্ষার্থীদের ক্ষতি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

৬. জাতীয় রাজনীতি মুক্ত পরিবেশ: জাতীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখা জরুরি।

পরিশেষে:

শিক্ষক রাজনীতি এবং গ্রুপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে না, বরং পুরো সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং ও রাজনীতির প্রভাব দূর করা জরুরি। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে একই মানসিকতা নিয়ে সমাজের জন্য কাজ করতে পারে।

লেখক: পরিচালক (ইনচার্জ), জনসংযোগ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ


সর্বশেষ সংবাদ