‘একটা সময় মনে হতো...ঢাবির দাসত্বের জীবন ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাই’

আব্দুল মাবুদ
আব্দুল মাবুদ  © সৌজন্যে প্রাপ্ত

একটা সময় আমার মনে হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জীবনে অনেক বড় ভুল করে ফেললাম কিনা! বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়াটাই কি ভুল ছিল! দীর্ঘ সময় আমি এই চিন্তাতেই বিভোর থেকেছি। এমন অনেকবার মনে হয়েছে যে, সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যাই। এভাবে দাসত্বের জীবন টেনে নিয়ে বেড়ানোর চেয়ে সেটাই আমার জন্য কল্যাণকর।” 

আমি আব্দুল মাবুদ। আর এটা আমার গল্প। কখনও ভাবিনি, এভাবে জোর গলায় আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতাকে দুনিয়ার মানুষের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাবো বা সেই হিম্মত দেখাতে পারবো। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের জেলা রংপুরে আমার জন্ম। যে এলাকার মানুষকে সবাই সহজ-সরল হিসেবে জানে। এমনই এক সহজ-সরল পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা পেশায় একজন মাদ্রাসা শিক্ষক এবং একইসাথে মসজিদের ইমাম। 

আট ভাইবোনের বিশাল সংসারে আমি সপ্তম সন্তান। এলাকার মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ক্লাসে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেছি। ২০১২ সালে পাবনা ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসি। 

বাঁধন, ‌সোহাগ, মুনতা‌সির, স‌জিব, রা‌কিব, রাব্বানীর সাথে না‌হিদ এবং সূর্য (ওপরে ডান দিক থেকে)। ছবি: লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

সেসময় আমার বাবা এবং প্রবাসী এক বড় ভাইয়ের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় কোচিং-এ ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে চান্স পাই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার তাৎপর্য আমি এভাবে অনুভব করতে পেরেছিলাম যে, পরিবারের বাইরেও গোটা গ্রামের মানুষজন আমার এই চান্স পাওয়ার ঘটনায় অনেক খুশি হয়েছিলো। 

কারণ, তখনো পর্যন্ত এই গ্রাম থেকে কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি। অর্থাৎ, আমিই ছিলাম আমার এলাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা প্রথম সন্তান। পরিবার, এলাকাবাসীর আশা-আকাংক্ষা আর নিজের ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে সাথে নিয়ে ২০১৩ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার জীবনের পরবর্তী যাত্রা শুরু করি। 

আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ফার্স্ট ইয়ারের শুরুতেই আমি হলে উঠি। আমাদের জন্য তখন সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় ছিল হলের গেস্টরুম কালচার। প্রথমদিন হল-এ এসেই রাতে যখন শুনি সবাইকে গেস্টরুমে ডাকছে তখন ভেবেছিলাম কোনো গেস্ট এসে অপেক্ষা করছে হয়ত। আর গেস্টরুম হচ্ছে যেখানে বাহির থেকে গেস্ট এসে অবস্থান করে বা থাকে। 

আরও পড়ুন: ঢাবির হলে যেভাবে হত্যা করা হয় তোফাজ্জলকে

কিন্তু বাস্তবের ধারণা পুরোপুরিই বদলে গেলো প্রথম রাতের গেস্টরুম অভিজ্ঞতার পর। গেস্টরুমের সাথে গেস্ট থাকার কোনো সম্পর্ক নেই আসলে। বরং এই শব্দটা দিয়ে একটা রেওয়াজ বা সংস্কৃতি বোঝায়। গেস্টরুম হচ্ছে হলের সেই খাস কামরা যেখানে প্রথম বর্ষে হল-এ ওঠা সকল ছাত্রকে একত্রিত করে মানসিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। 

আর এই জিনিসটা করা হয় হলের সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়রদের ম্যানার বা উত্তম আচার-ব্যবহার শেখানোর নাম করে। যেমন– সিনিয়রকে ভুল করেও সালাম না দেওয়ার ব্যাপারটা যে এত ভয়াবহ মাত্রার অপরাধ হতে পারে, অথবা সালাম যে এভাবে জোর করে নিতে হয় বা নেওয়া যায়–এরকম কোনো ধারণা আমার এর আগে কোনোদিন ছিল না। 

কোন গলিতে কোন বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হলে সালাম দেওয়া হয়নি, কে কে পলিটিক্যাল প্রোগ্রামে যায়নি, কাকে ক্যাম্পাসের কোন নিষিদ্ধ জায়গায় দেখা গেছে, যেখানে ফার্স্ট ইয়ারের কোনো ছাত্রের যাওয়া সিনিয়র কর্তৃক কঠোরভাবে নিষেধ–এ সমস্ত কিছু নিয়েই মূলত বিচার বসতো প্রতিরাতের গেস্টরুমে। 

আরও পড়ুন: ঢাবিতে পিটিয়ে যুবক হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাসহ দুজন আটক

আর সেটা এমনই এক বিচার ব্যবস্থা ছিল যেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আত্মপক্ষ সমর্থন করা মানে বড় ভাইদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, যেটা নিঃসন্দেহে আরো গুরুতর অপরাধ। রাত নয়টা/দশটায় শুরু হয়ে কখনও দুইটা/তিনটা বেজে যেতো গেস্টরুমের এই তামাশা শেষ হতে হতে। এভাবেই চলছিলো আমাদের গেস্টরুম সংস্কৃতির নিত্যদিনের উদ্‌যাপন। আর হল-এ থাকতে হলে গেস্টরুমে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। এটাই হলের অঘোষিত নিয়ম। 

এর বাইরে প্রথম বর্ষের জন্য আরেক বিভীষিকার নাম ছিল গণরুমের ফ্লোরে ফ্লোরিং করে একসাথে বিশ/পঁচিশ জনের বসবাস। এক রকম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেই কাটতে লাগলো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। 

গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা আমার মতো অপরিপক্ব এক তরুণের জন্য প্রথম বর্ষের শুরুতেই এইসব গ্লানিময় ধকল সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠছিলো দিন দিন। হতাশা গ্রাস করছিলো আমাকে। নিজেকে কখনও কখনও মনে হতে লাগলো– এক অসহায় দাস। যেদিন গেস্টরুম থাকতো না সেদিন দাসত্বের বেড়া ডিঙিয়ে অনেকটা স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম। আর গেস্টরুমের দিনগুলোতে বুকে কাঁপন উঠতো প্রায় সবারই। 

আরও পড়ুন: ঢাবির হলে যুবককে পিটিয়ে হত্যায় প্রশাসনের মামলা

কারণ এটা নিশ্চিত ছিল যে সিনিয়ররা কিছু না কিছু ভুল খুঁজে বের করবেই। তারপরই শুরু হবে মা-বাপ তুলে গালিগালাজ থেকে শুরু করে অমানুষিক মানসিক নিপীড়ন। কপাল খারাপ থাকলে কারো কারো শরীরেও প্রবাহিত হতো সেই নিপীড়নের ছাপ। তখনও আমি জানি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন আমাকে নিত্যদিনের চলমান এই নিপীড়ন ভোগ করা থেকে মুক্তি দিবে এর চেয়েও তীব্র শারীরিক নিপীড়নের শিকার বানিয়ে।

যেদিন ঘটনা টা ঘটলো সেদিন রাতে গেস্টরুম ছিল। মুখে দাড়ি এবং পান্জাবী-পায়জামা- টুপি পরিহত থাকার কারণে গেস্টরুমে আমার উপর বেশি নজর রাখা হত এবং চাপে রাখা হত। আর কোনো এক কারণে আমি সেই গেস্টরুমে উপস্থিত হতে পারিনি। 

এটা নিয়ে বরিকুল ইসলাম বাঁধন সঙ্গীত (১২-১৩সেশন) নামে সেকেন্ড ইয়ারের হলের ইমিডিয়েট সিনিয়র এক বড় ভাই আমাকে ফোন দেয়। বাঁধন পরবর্তীতে ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধু হল শাখার সভাপতি হয়। ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতিও সে। 

আরও পড়ুন: তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় ঢাবির তদন্ত কমিটি, প্রতিবেদন সন্ধ্যায়

তো সেদিন আমাকে ফোন দিয়েই জিজ্ঞেস করে যে, আমি কোথায় আছি। আমি তাকে জানালাম যে, আমি একটা জরুরি কাজে বাইরে এসেছি। তখন আদেশের সুরেই সে বললো ‘জরুরি কাজ বাদ, তোকে ইমিডিয়েটলি গেস্টরুমে আসতে হবে’। বাধ্য হয়ে আমি তখন গেস্টরুমে ফিরে আসি। 

যেভাবেই হোক সেদিন আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে গেস্টরুম আছে।এছাড়া ব্যক্তিগত কিছু কাজও ছিল যার জন্য মানসিকভাবে একটু প্রেশারে ছিলাম। এ কারণে সম্ভবত গেস্টরুম থাকার ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। 

আমি ফিরে আসার পর বাঁধন শুরুতেই আমার ফোনটা কেড়ে নেয় এবং জিজ্ঞেস করে যে, আমি ফেসবুক চালাই কি-না। এরপর আমার থেকে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড নিয়ে আমার ফেসবুক আইডি, অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকি আমার পুরো ফোনই সে চেক করা শুরু করে। 

আরও পড়ুন: আবরারের মৃত্যু দেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে: ছাত্রলীগ

দীর্ঘ সময় ঘাঁটাঘাঁটির পর ফেসবুকে ‘সোনার বাংলা’ নামে একটা পেইজে আমার ফলো দেয়া দেখে সেটা নিয়েই প্রশ্ন শুরু করে যে, এই পেইজে আমার ফলো দেওয়া কেন। তখন তার পাশ থেকে আরেকজন বলে ওঠে, ‘সোনার বাংলা তো জামাতের পত্রিকা, এই ছেলে নিশ্চিত শিবির করে। ওকে ধরে সাইডে রাখ।’ 

এরপর আমাকে একপাশে রেখে বাকিদের মধ্য থেকে আরও একজনকে এভাবে ধরে আমার পাশে আনে। তার নাম সুমন, সেও আমারই ব্যাচের, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ডিপার্টমেন্টের, জেলা পঞ্চগড়। এর কিছুক্ষণ পর সেখানে আরো কয়েকজন সিনিয়র ভাই আসে। 

এর মধ্যে মুনতাসির নামের একজন ছিল সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের, বাড়ি সাতক্ষীরায়। নাহিদ নামের আরেক সিনিয়র ফিনান্স ডিপার্টমেন্ট (যার বাড়ি গোপালগঞ্জ) এসে আমার ফেসবুক আবার চেক করা শুরু করে কিছুক্ষণ পর বলে ওঠে, ‘এর ফেসবুক দেখে তো মনে হচ্ছে এ জামাত-শিবির করে।’

আরও পড়ুন: আবরার মরেছে, আমি বেঁচে আছি—তাই পত্রিকার শিরোনাম হইনি

এরপর অকস্মাৎ আমার আর সুমনের চোখ বেঁধে ফেলে ওখানে টর্চারের সময় ছিলেন ইমিডিয়েট সিনিয়র, বরিকুল ইসলাম বাধন, সঙ্গীত ১২-১৩ সেশন। পিতা- নোহা মনিরুল ইসলাম, গ্রাম-রাজনগর, পো- আবুরী মাগুড়া, থানা- মিরপুর, জেলা- কুষ্টিয়া।

সজীব পলিটিক্যাল সায়েন্স ২০১২-১৩ সেশন, যশোর; বর্তমানে জনতা ব্যাংক নোয়াখালী শাখায় কর্মরত; ছানাউল্লা সূর্য , পিতা-সাজিদুর রহমান, গ্রাম পবহাটি মোল্লাবাড়ী, পো-থানা-জেলা-ঝিনাইদহ, রাকিব হাসান, আই আর সেশন ২০১২-১৩ পিতা-আবুল হাসান ৫১৫-১ শিশুবন, গোপালগঞ্জ সদর, গোপালগঞ্জ বর্তমানে কাউন্টার টেরোরিজমে কর্মরত; আবু জাফর সোহাগ ইসলামিক স্টাডিজ ২০১২-১৩ সেশন, পিতা মোজাম্মেল হক, শাহানাজ খাতুন, গ্রাম-চর রাখাইল, থানা-ইবি, পো- উজান গ্রাম,জেলা-কুষ্টিয়া এবং অন্যান্যরা। 

একজন কোমর থেকে চামড়ার বেল্ট খুলে সেটা দিয়েই আমাদেরকে মারা শুরু করে। আমরা ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে মার খাচ্ছিলাম। এভাবে অনেকটা সময় নিয়ে আমাদের উপর বেল্টের বাড়ি চললো। কিছু সময় পর এর সাথে যুক্ত হয় ক্রিকেট স্ট্যাম্প। ততক্ষণে প্রায় ২০ জন জড়ো হয়ে গেছে সেখানে।

আরও পড়ুন: আবরার হত্যার পরও ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বন্ধ হয়নি মারধর-নির্যাতন

ক্রমাগত বেল্ট আর স্ট্যাম্প দিয়ে পিটানোর পাশাপাশি একটু পর পর চলে ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন। ‘তোদের সাথে আর কে কে আছে?’, ‘সবার নাম বল’, ‘কার পোস্ট কী?’ ‘কে কোন হলে থাকে?’ ইত্যাদি। বাঁধন, সজিব, রাকিব, সবুজ এই নির্মম টর্চারে নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। শুরুতে আমার মুখ দিয়ে কষ্টের চিৎকার বের হচ্ছিলো। 

অনেক পেটানোর পর যখন আমি আর চিৎকার করার শক্তি পাচ্ছিলাম না তখন তাদের মধ্যে কেউ একজন বললো যে, এ অনেক শক্ত, এরে আরো পিটা। সেদিন আমি গেস্টরুমে পৌঁছাই রাত পৌনে দশটার দিকে। তারপর ঘণ্টা দুয়েক চলে আমাদের দুজনের উপর এই নারকীয় নির্যাতন। সেই মুহূর্তে কেউ একজন এসে বলে, ‘ঠিক আছে আর দরকার নাই, হয়ত কোনো নাম নাই ওদের কাছে। আর তাছাড়া পুলিশ আসছে, পুলিশে দিয়ে দে ওদেরকে।’

ততক্ষণে হল ছাত্রলীগের সভাপতি পুলিশকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে। সেসময় বঙ্গবন্ধু হলের সভাপতি ছিল দারুস সালাম শাকিল। টর্চারের সময় উপস্থিত না থাকলেও সে পুলিশ ডেকে নিয়ে আসছিলো এই খবরটুকু পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম। 

আরও পড়ুন: আবরার স্মরণসভায় ছাত্রলীগের হামলা ও গ্রেপ্তারের নিন্দা ২৩ নাগরিকের

আনুমানিক রাত সাড়ে বারোটার দিকে পুলিশ আমাদেরকে হল থেকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। আমার পিঠের চামড়ায় বেল্টের আঘাতগুলো গাঢ় দাগ রেখে দিয়েছিল। পিঠের চামড়া ফেটে সেখান থেকে রক্ত বের হয়ে জমে গিয়েছিলো। 

শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়ার পর সেখানের এক হাবিলদার কিছু ওষুধ নিয়ে এসে আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন। আমরা ডেটল দিয়ে আমাদের পিঠটা পরিষ্কার করে পেইন কিলার খেয়ে নিই। এরপর দুইদিন আমাকে শাহবাগ থানার হাজতে থাকতে হয় এবং পরিবারসহ থানার কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেতে হয়।

এই ঘটনার পর আমার ক্লাসমেটরা বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলেকে কেন এভাবে মারধর করা হবে। তাছাড়া আমার নিরীহ স্বভাবের কারণেও তাদের ক্ষোভ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু কারোর কিছু করার ছিল না। তবে হল-এ আমার ইয়ারের ছেলেদের মধ্যে এই ঘটনাটা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। 

আরও পড়ুন: ‘বিচার চাওয়ার জন্য তোফাজ্জলের মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই, তবে আমি আইনিভাবে লড়ব’

একটা আতঙ্ক তৈরি হয় তাদের মাঝে। কার্যত তারা ক্যাম্পাসে আমাকে প্রকাশ্যে এড়িয়ে চলা শুরু করে। যদিও ক্যাম্পাসের বাইরে তাদের সাথে দেখা হলে সহজভাবেই কথা বলতো। এ থেকে আমি বুঝতে পারি– হলে থাকার কারণে তাদের মধ্যে এই ভয়টা ছিল যে আমার সাথে সখ্যতার কারণে তাদের উপরেও টর্চার নেমে আসতে পারে।

ফার্স্ট ইয়ারের এই ঘটনার পর আমি আর হলে থাকতে পারিনি। আমাকে চিরতরে হল ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আজিমপুরের এক মেস-এ থেকে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি জীবন পার করেছি। আমার নির্যাতিত হয়ে থানায় যাওয়ার ঘটনাটা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিলো আমার বাবাকে। 

তিনি অনেক বেশি ভীত হয়ে পড়েন। তিনি যখন জানতে পারেন আমাকে এভাবে মারধর করে থানা হাজতে দেওয়া হয়েছে তখন কান্না করে দিয়ে বলেছিলেন যে, এত পড়াশোনা করে কী হবে? আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যও খুব চেষ্টা করেছিলেন তিনি তখন। তার ভয়টা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে বলেছিলেন, ‘পড়াশোনার দরকার নেই, আমার ছেলে আমার কাছে ফিরে আসুক’।

আরও পড়ুন: বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জাবিতে বিক্ষোভ

যাইহোক, এই ঘটনার পর আমি আর কখনো আমার হলের দিকে আর পা বাড়াইনি। এমনকি আমি আমার জিনিসপত্রগুলোও হল থেকে বের করার সাহস পাইনি। আমার যে বন্ধুর সাথে আমি পাশাপাশি ফ্লোরিং করে থাকতাম সে খুব ভোরে উঠে আমার জিনিসগুলো আস্তে আস্তে আমাকে পৌঁছে দেয়। এভাবেই আমি আমার জিনিসপত্র ফেরত পাই। 

নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতনের পরেও আমার বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি হয়নি যদিও। মানসিক একটা ট্রমা তৈরি হয়েছিল। সেটা আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম ক্লাসমেট আর বিভাগের শিক্ষকদের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণে। 

তবে এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতির স্বীকার আমাকে হতে হয় তা হচ্ছে আর্থিক ক্ষতি। হলের বাইরে থাকার কারণে প্রতি মাসে থাকা-খাওয়ার জন্য বেশ বড় অঙ্কের একটা খরচ আমাকে বহন করতে হয়েছে। আমার মতো বড় পরিবারের সন্তানের জন্য বাবার আয়ের সংসার থেকে নিয়মিত টাকা আনা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। 

আরও পড়ুন: জাহাঙ্গীরনগরে গণধোলাইয়ের পর হাসপাতালে সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু

ফলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাকে ঢাকা শহরের মতো খরুচে জায়গায় আর্থিকভাবে সংগ্রাম করে দিন চালাতে হয়েছে সেই ঘটনার পর থেকেই।

আমি বর্তমানে একটা ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত আছি। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার মাঝেও যতটুকু সময় পাই চেষ্টা করি আমার সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার। বিশেষ করে আমার গ্রামের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার যাত্রাকে সহজ করার জন্য তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতামূলক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছি। 

তবে আমি চাই না, গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে এসে আমার মতো নির্মম রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হোক কেউ। আমি চাই সবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিরাপদ এবং ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণের পথে সহায়ক হোক।

লেখক: আব্দুল মাবুদ
আরবি বিভাগ, ২০১৩-১৪সেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ