নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা রোধে দরকার সচেতনতা ও কর্মের স্বাধীনতা

সাবিকুন নাহার রোশনী
সাবিকুন নাহার রোশনী  © টিডিসি ফটো

‘‘কোনো কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারি, 
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী’’

কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই পঙ্‌ক্তি যুগলের মতো নারীরা নিভৃতেই পরিবার, সমাজ, দেশ, সর্বোপরি বিশ্বের কল্যাণে কাজ করেন। তারপরও নারীদের বিভিন্ন অবস্থানে ভিন্নরকম সহিংসতার শিকার হতে হয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, বিশ্বের প্রতি ৩ জন নারীর মাঝে ১ জন নারী জীবনের কোনো পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া ব্রিটিশ ক্রাইম সার্ভের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ৪ জন নারীর কমপক্ষে ১জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০জন। জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেলেও কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। ভারতীয় উপমহাদেশের এই পুরুষতান্ত্রিক দেশের সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতাকে নারীর প্রতি পুরুষের অধিকার বলেও চালিয়ে দেওয়া হয় অনেক সময়। আর নারীর প্রতি এই সহিংসতার মধ্যে সব থেকে বিশি লক্ষ্য করা যায়, ‘‘পারিবারিক সহিংসতা।’’

পরিবার হলো এমন একটি জায়গা যেখানে নারীর সবচেয়ে বেশি নিরাপদ থাকার কথা, যেখানে থেকে নারীর বিকশিত হওয়ার কথা। কিন্তু নারী পরিবারেও নিরাপদ নয় কিংবা সহিংসতা থেকে মুক্ত নয়। পারিবারিক সহিংসতা (ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতা নামেও পরিচিত) হলো গার্হস্থ্য পরিবেশে সংগঠিত হওয়া এক ধরনের ব্যবহারের প্যাটার্ন যা অংশীদার বা অন্তরঙ্গ অংশীদারের ওপর ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ অর্জন এবং তা বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজারেরও অধিক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল রিফিউজি কমিটির একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, নারী নির্যাতনে সারাবিশ্বের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কুমিল্লার তনু হত্যা থেকে শুরু করে গৃহকর্মী প্রীতি উড়াং হত্যা সবই নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম উদাহরণ।

জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদগুলোর ওপর ভিত্তি করে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে তৈরি একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিবাহিত নারীর ৮০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে নিজেদের আশ্রয়স্থলে নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার ৪২ শতাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে নারীরা তাদের স্বামীর দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন। সেইসঙ্গে নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে ২৬ শতাংশ নারী বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ।

অন্য আরেকটি জরিপের তথ্যমতে, ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী পারিবারিক বলয়ের মাঝে তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে জানান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ১৫ জন নারী স্বামীর দ্বারা খুনের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে (২০১১) জানা যায়, ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী তাদের স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। নারী প্রত্যহ স্বামী, ভাই-বোন, শ্বশুর -শাশুড়ি, বাবা-মা, সহকর্মী, সন্তান, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এবং অনেক সময় অপরিচিতদের দ্বারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন।

ডায়ান মেরিচাইল্ডের মতে, ‘একজন নারী হলো সম্পূর্ণ বৃত্ত। যার মধ্যে সৃষ্টি, লালন ও রুপান্তর করার শক্তি রয়েছে।’ নারীকে সমাজের প্রকৃত স্থপতি বলা হলেও বিভিন্ন কারণে সমাজে নারীরা নির্যাতিত হয়। নারীর প্রতি পারিবারিক এ সহিংসতার প্রধান নিয়ামক হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। এই সমাজে নারীদের ব্যাপারে অন্যতম মিথ হলো নারীরা তৈরি হয়েছেন "সুগার এন্ড স্পাইস এভরিথিং নাইস" থেকে। তাই তারা পুরুষের অধীনে থাকবে এবং আনুগত্য শিকার করবে।

নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার আরও কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— দারিদ্রতা, যৌতুক, স্বামীর পরকীয়া ও দ্বিতীয় বিয়ে, পুত্র সন্তান জন্ম না দেওয়া, স্বামীর আদেশ পালন না করা, স্বামীর থেকে আর্থিক সাহায্য চাওয়া প্রভৃতি। শুধুমাত্র নারী হওয়ার জন্যও অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতার শিকার হতে হয় অনেককে।

বাংলাদেশে নারীরা শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- এসিড নিক্ষেপ, খুন, জখম, পতিতাবৃত্তি, ধর্ষণ, মারধর, পোড়ানো, ভরণপোষণ না দেওয়া, ভীতি প্রদর্শন, তালাকের ভয় দেখানো, কাজ করতে বাধা দেওয়া, জোরপূর্বক গর্ভপাত ইত্যাদি।

পারিবারিক এসব সহিংসতার শিকার নারীর স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, মর্যাদাবোধ, নিরাপত্তাবোধ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। এর ফলে নারীর মাঝে হতাশা, দুশ্চিন্তা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, হীনম্মন্যতা দেখা যায়। এক সময় নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

নারী নির্যাতন দমনের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আইনের ব্যবস্থা করলেও পারিবারিক সহিংসতা দূরীভূত করতে সক্ষম হয়নি। ঢাকা শহরের মাঝে এক জরিপে দেখা যায়, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীরা নির্যাতনের পরেও স্বামী এবং পরিবারের সাথে থেকে যায়। এর অন্যতম কারণগুলো হলো— নারীর আর্থিকভাবে স্বাধীন না হওয়া, আইনি সহায়তা নিতে গেলে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ (ভিক্টিম ব্লেমিং) ,সরকারিভাবে পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়া, সামাজিকভাবে হেয় হওয়া প্রভৃতি।

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর—জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

সমাজের অর্ধেক অংশকে বাদ দিয়ে কখনও উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীর মাঝে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। নারীকে উন্নয়নে শামিল করতে প্রয়োজন নারীমুক্তি এবং নারীর অধিকার সুনিশ্চিতকরণ। বর্তমানে বলবৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন নারী এবং পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। 

নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা রোধের সচেতনতা তৈরির প্রথম ধাপ হওয়া উচিত পরিবার। কারণ, একজন সন্তানের মানসিকতা সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে পরিবার। সেইসঙ্গে পারিবারিক সহিংসতার মতো সমস্যাকে দূর করতে নারীদের কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা উচিত বা যথাযথভাবে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। 

এছাড়া নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা রুখতে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন অতীব জরুরি। সমাজের উন্নয়নে কাজে লাগাতে নারীর বেড়ে ওঠার পথকে করতে হবে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। তবেই নারী মুক্ত বিহঙ্গীর মতো বিকশিত হতে পারবে। এর মাধ্যমেই, নারী-পুরুষ সর্বোপরি আমাদের সমাজ এবং দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ