আন্দোলনে আহতদের নিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশন কী করছে— ফেসবুকে তাসনিম জারার কৈফিয়ত
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১০ PM , আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৫ PM
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় অবহেলা ও বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ অবস্থায় আন্দোলনে আহতদের সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে গঠিত জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মেডিকেল টিম নেতা ও যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসনিম জারা ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে কৈফিয়ত দিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাতে স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, এই আলোচনার প্রেক্ষিতে জুলাই ফাউন্ডেশন কী করছে? এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে ও গত সপ্তাহের কাজের আপডেট শেয়ার করতে লিখছি— ফাউন্ডেশনের নিজস্ব হাসপাতাল নেই। আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের, তাদের রয়েছে হাসপাতাল ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। ফাউন্ডেশনের পক্ষে সকল আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়।
স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, তাহলে চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা কী করি? ফাউন্ডেশন যখন হটলাইন চালু করে, তখন অনেকে যোগাযোগ করে চিকিৎসাসেবা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে। ফাউন্ডেশন এদের পাশে দাঁড়াতে একটা মেডিকেল টিম গঠন করে। আমরা মেডিকেল টিম থেকে রোগীদের সাথে কথা বলে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করি তার হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন কি না। প্রয়োজন হলে আমরা তার জন্য উপযুক্ত হাসপাতাল রেকমেন্ড করি। এই হাসপাতাল নির্বাচন করি রোগীর বাসা থেকে হাসপাতালের দূরত্ব, পূর্বে কোথায় চিকিৎসা হয়েছে, রোগীর প্রয়োজন ও সেবার মান অনুযায়ী। রোগী কখন আসতে পারবে সেটা জেনে নেয়ার পর হাসপাতালে যোগাযোগ করে জানাই যে আমাদের একজন রোগী এই সময়ে আসবেন, আপনারা অনুগ্রহ করে তাকে দ্রুত সেবা প্রদান করবেন। এই বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবার মহাপরিচালক ডা. আবু জাফর স্যার আমাদেরকে আন্তরিকতার সাথে সহায়তা করেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসার দায়িত্ব হাসপাতালের থাকে। আমরা রোগীদেরকে বলি যে কোনো অসুবিধা হলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। আমাদের সাথে ওনারা যোগাযোগ করলে আমরা সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করি।
আহত রোগীদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে এটার ব্যাপারে ফাউন্ডেশন কী করতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে জারা বলেন, রোগীর বিদেশে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সরকারের তরফ থেকে করা হয়। সাধারণত হাসপাতাল থেকে সরাসরি মন্ত্রণালয়ে রেকমেন্ডেশন পাঠানো হয় বিদেশে চিকিৎসার জন্য। এই প্রক্রিয়ার বাইরে আমাদের কাছে কেউ যোগাযোগ করলে আমরা খুব দ্রুত এই অনুরোধ গুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। এরপর থেকে কাজ মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা হয়েছে যে কিছু ক্ষেত্রে বিদেশে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ ও বিশেষজ্ঞ সেন্টার নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা ফাউন্ডেশন থেকে মতামত দিতে পারি। তবে এটা মন্ত্রণালয় থেকে চাইলেই আমরা করতে পারি, না চাইলে নয়। অতীতে মন্ত্রণালয় যখন আমাদের এই সহযোগিতা চেয়েছে, আমরা সেটা করেছি।
“আপনাদের মত আমারও মনে হয় বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ক্ষেত্রে এই দীর্ঘসূত্রিতা গ্রহণ যোগ্য নয়। কারণ এমন কিছু রোগী আছেন যাদের চিকিৎসা করতে দেরি হলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই বিদেশে যাওয়ার রেকমেন্ডেশন পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় এই কাজটা করতে যদি ১ থেকে ২ দুই মাস সময় নেন, এটা অনেক বড় ব্যর্থতা। আমার যখনই সুযোগ আসে, এই ব্যাপারে আওয়াজ তুলি।”
গত সপ্তাহের কাজের আপডেটের ব্যাপারে তাসনিম বলেন, এ সময় আমাদের মেডিকেল টিমের সাথে ১১৮ জন রোগীর যোগাযোগ হয়েছে। এর মধ্যে আমরা ১১৬ জনকে সেবা দিয়েছি।
গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে— যে ১১৮ জন যোগাযোগ করেছিলেন তাদের মধ্যে ২৭ জনের অবস্থা এমন ছিল যে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। আমরা তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন হাসপাতালের সাথে কাজ করছি: ৮ জনের সিএমএইচ ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সেন্টারে, ৬ জনের ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে, ২ জনের নিটোরে (পঙ্গু হাসপাতাল), ২ জনের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে, ১ জনের বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতালে), ১ জনের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে, ১ জনের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে, ১ জনের ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউটে, ১ জনের সিএমএইচ চট্টগ্রামে, ১ জনের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে, ১ জনের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ বরিশালে, ১ জনের ফজিলাতুন্নেসা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ ও ভর্তির ব্যবস্থা করেছি। এসব ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকে হাসপাতালের সাথে কথা বলি যাতে তারা রোগীর জন্য রেডি থাকে। রোগীর সাথে যোগাযোগ রাখি যাতে তারা কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি। এক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদ, সিএমএইচ এর কমান্ডেন্ট, নিটোরের পরিচালক ডা. আবুল কেনান, ডিরেক্টর অব হসপিটালস ডা. মইনুল আহসানসহ আরও কয়েকজন বিশেষ সহযোগিতা করেছেন। ১ জনের জরুরি ভিত্তিতে হার্টের অ্যানজিওগ্রাম করানো প্রয়োজন ছিল। তাকে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তির ব্যবস্থা করেছি ও তার চিকিৎসার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভর্তি ও চিকিৎসার ব্যাপারে হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. ওয়াদুদ স্যার বিশেষ সহযোগিতা করেছেন।
বিদেশে চিকিৎসা
আমাদের কাছে ৩ জন রোগী এসেছেন যাদের বিদেশে যাওয়ার রেফারেল লেটার আছে হাসপাতাল থেকে, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা হয় নি। আমরা এই ৩ জন রোগীকে বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মিনিস্ট্রির সাথে যোগাযোগ করেছি। মিনিস্ট্রির কাছে রোগীর সকল প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট গুছিয়ে সাবমিট করেছি। আগে ৬ জন রোগীর বিদেশে যাওয়ার জন্য কাগজপত্র রেডি করে সাবমিট করেছিলাম। মিনিস্ট্রির কাছ থেকে নিয়মিত আপডেট নিচ্ছি এই ৬ জন রোগীর বিদেশে পাঠানোর বর্তমান অবস্থা কী এবং রোগীকে সে বিষয় অবহিত করে রাখছি।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবা
আন্দোলনে আহত অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। যেমন ডিপ্রেশন, পিটিএসডি, প্যানিক ডিজঅর্ডার, ইত্যাদি। আমরা ৬৬ জনকে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করেছি। ৫৫ জনের দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিং প্রয়োজন ছিল। তাদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য আমরা বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (NIMH), এবং সাজিদা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করে প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করেছি।
আর্থিক সহায়তা
১৪ জন জরুরি আর্থিক সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। তাদের দ্রুত সহায়তা নিশ্চিত করতে ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন এবং ফাইনান্স টিমের সঙ্গে কাজ করছি।
যোগাযোগের সমস্যা
যে ২ জন রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি (ফোন বন্ধ ছিল বা ফোন ধরেননি), আমরা তাদের সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করব। আমি জানি যে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই সেভাবে হয় নি। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমি চেষ্টা করছি সকলের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে। আপনার পরিচিত কোন আহত ব্যক্তির চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন সহায়তা লাগলে আমাদের জানাবেন। ১৬০০০ নম্বরে কল দিয়ে।
আমরা সবসময় আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে প্রস্তুত আছি; আপনারা শুধু আমাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিন।
স্ট্যাটাসের শেষে তিনি লিখেছেন, আপনারা অনেকে বলেছেন যে আহতদের পক্ষ থেকে যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা না করে আমাদের নিজেদের তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করা উচিত। এটা করার জন্য যা যা লাগবে - জনবল, একটা বসার জায়গা, কিছু বাজেট - তা ম্যানেজ করতে একটা প্রপোজাল লিখেছি। এটা যদি গভর্নিং বডি থেকে অনুমোদন পায়, তাহলে এটা বাস্তবায়ন করবো।