মাভাবিপ্রবির সংস্কৃতিচর্চার বাতিঘর ‘ধ্রুবতারা’

ধ্রুবতারা সংগঠনের সদস্যরা
ধ্রুবতারা সংগঠনের সদস্যরা  © টিডিসি ফটো

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি) সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র টেকনো-কালচারাল ক্লাব ‘ধ্রুবতারা’। ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করা এ সংগঠনটি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মকাণ্ডের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মঞ্চ হিসেবে পরিচিত। ২০১০ সালে মাভাবিপ্রবি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ততটা সমৃদ্ধ ছিল না। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্ল্যাটফর্মের অভাব ছিল। ঠিক এমন সময়, একদল উদ্যমী তরুণ মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে নিজেদের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

প্রথমদিকে সংগঠনের মিটিং গানের আসর, অনুষ্ঠানগুলো খোলা আকাশের নিচে অনুষ্ঠিত হতো। সীমিত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তারা কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সংগঠনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।  রোদ, বৃষ্টি, ঝড়—কিছুই থামাতে পারেনি তাদের। কখনো ঝকঝকে রোদ, কখনো ঝুম বৃষ্টি, কখনোবা তীব্র শীত— কিন্তু তাদের অনুপ্রেরণার আগুন কখনো নিভে যায়নি। সংস্কৃতির মশাল হাতে এগিয়ে গেছেন তারা, এক বিশ্বাস নিয়ে—একদিন ধ্রুবতারার আলো পুরো ক্যাম্পাসকে আলোকিত করবে।

অবশেষে, সংগঠকদের নিষ্ঠা, উৎসাহ ও নিরলস প্রচেষ্টা দেখে এবং তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমবারের মতো কোনো সংগঠনকে নিজস্ব ঘর বরাদ্দ করে। সেই ঘরের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মাত্র একটি শব্দ— ‘ধ্রুবতারা’। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে “সংস্কৃতির পাল ছেঁয়ে, প্রযুক্তির হাল বেয়ে, সভ্যতার বন্দরে গাঁথবো নোঙর” মূলমন্ত্র ধারণ করে এগিয়ে চলেছে।

ধ্রুবতারার যাত্রা শুরু হয় একটি আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে। মহসিন আলম আহ্বায়ক ও মো. রফিকুল ইসলাম সদস্য সচিব হিসেবে ছয় মাসের জন্য দায়িত্ব পালন করেন। সদস্য হিসেবে ছিলেন আইসিটি বিভাগের মাহমুদুল হাসান রাজিব , সিএসই বিভাগের মনোয়ার হোসেন। এরপর এক বছর মেয়াদি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়, যেখানে সভাপতি হন মো. রফিকুল ইসলাম, আর সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব পালন করেন সালামুনহিয়া রিপন। ১৫-২১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির তত্ত্বাবধানে ধ্রুবতারা আরও সংগঠিত হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ জন, যা বর্তমানে প্রায় ১০০ তে পৌঁছেছে। ধ্রুবতারার অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদান রেখেছেন টেক্সটাইল বিভাগের কিশোর চন্দ্র ভৌমিক, সোহাগ সরকার, ইমতিয়াজ, মুজাহিদ, সিপিএস বিভাগের সজিব দে এবং আসিফ। তারা শুধু ক্লাবের প্রথম দিকের সার্বিক সহযোগিতাই করেননি, বরং পরবর্তীতে ক্লাবের হাল ধরার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছেন।

ধ্রুবতারার প্রতিষ্ঠাতা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা অনেক কষ্ট করে এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছি। আর কোনো কিছু যখন কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তার স্থায়িত্বও হয় অনেক বেশি।” তিনি আরো বলেন, “সংগঠনটি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। মাভাবিপ্রবির সংস্কৃতিচর্চার বাতিঘর হয়ে, ‘ধ্রুবতারা’ তার নামের মতোই চিরকাল জ্বলজ্বল করবে আকাশে।”

দেশের চরম সাংস্কৃতিক দুঃসময়ে শক্ত হাতে সংস্কৃতির হাল ধরে রাখার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ধ্রুবতারা এগিয়ে চলছে। প্রতিকূলতার মাঝেও সংগীত, নৃত্য, অঙ্কন এবং আবৃত্তি চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ক্যাম্পাস ও দেশের বাংলা সংস্কৃতিকে জাগ্রত রাখাই এর প্রধান লক্ষ্য।

জাতীয় ও ঐতিহ্যবাহী বিশেষ দিনগুলো— একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস—ধ্রুবতারা যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করে। এই দিনগুলিকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ধ্রুবতারার প্রাণবন্ত কার্যক্রমকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।

এখানে যে কেউ গান, নাচ ও বাদ্যযন্ত্র শিখতে পারেন একেবারে বিনামূল্যে। শুরুর দিকে ধ্রুবতারার আজীবন সম্মাননা প্রাপ্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস এটেনডেন্ট মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম ছিলেন সংগঠনের সংগীতচর্চার অন্যতম ভিত্তি। তিনি হারমোনিয়াম, তবলা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতেন নিষ্ঠা ও ভালোবাসার সঙ্গে, যা সংগঠনের সুরের জগতে এক দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলে। সংগঠনের আরেকটি বিশেষ আয়োজন সাপ্তাহিক আবৃত্তি মহড়া, যা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি সোমবার। এখানে শিক্ষার্থীরা আবৃত্তি ও উপস্থাপনার কৌশল রপ্ত করেন। এই মহড়ার প্রশিক্ষক ধ্রুবতারার আজীবন সম্মাননা প্রাপ্ত আবৃত্তিশিল্পী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার সৈয়দ সাইফুল্লাহ। তার তত্ত্বাবধানে নতুন প্রজন্মের আবৃত্তিশিল্পীরা নিজেদের কণ্ঠে প্রাণ এবং উপস্থাপনায় শৈল্পিক ছোঁয়া এনে দিচ্ছেন।

ধ্রুবতারা সাহিত্যচর্চাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজন ও বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভাকে বিকশিত করতে কাজ করে ক্লাবটি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর যথাযথ উদযাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে।

শুধু সাহিত্য ও সংস্কৃতি নয়, ধ্রুবতারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত কর্মশালা, সেমিনার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা এবং বিভিন্ন মানবিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থেকে সমাজকল্যাণে কাজ করে। মানবতার কল্যাণে অবদান রাখার লক্ষ্যে ধ্রুবতারা সর্বদা নিয়োজিত।

নাচ, গান, অঙ্কন বা আবৃত্তিতে পারদর্শী না হলেও ধ্রুবতারায় অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। সাংগঠনিক দক্ষতা ও ম্যানেজমেন্ট ধ্রুবতারার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে যে কেউ নিজেকে যুক্ত করতে পারে। ধ্রুবতারার কার্যক্রমকে এককথায় সংক্ষেপে বলতে গেলে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন ও মানবতার কল্যাণ এই লক্ষ্যেই ধ্রুবতারা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে!

সাবেক সহ-সভাপতি আবু হানিফ বলেন, “শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মাভাবিপ্রবির আকাশে ধ্রুবতারা যেন একই আলোয় অবিচল থাকে, প্রজ্বলিত হয় নতুন সম্ভাবনার দীপ্তিতে—এটাই আমার একান্ত চাওয়া। মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। অগ্রযাত্রা হোক অবিচল, আলোকিত হোক ভবিষ্যৎ!”

জানা যায়, ধ্রুবতারার আবৃত্তি বিভাগ জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সংগঠনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ত্রৈমাসিক আবৃত্তি অনুষ্ঠান 'বেলা অবেলা কালবেলা', যা খুব শীঘ্রই আবার শুরু হতে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের যে কেউ ধ্রুবতারার সদস্য হতে পারেন। সদস্য হতে চাইলে  নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পূরণ করতে হয়,  নেই কোনো জটিলতা। ধ্রুবতারার সদস্য হওয়ার একটিই শর্ত— আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য হতে হবে, আর কিছু নয়। তবে একবার ধ্রুবতারায় যোগ দিলে কেউ আর ফিরে যেতে চায় বলে মনে হয় না! ক্লাবের প্রাণবন্ত পরিবেশই সবাইকে এখানে আটকে রাখে বলে অন্যান্য সদস্যদের দাবি। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে রয়েছে এক অসাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক, যা ধ্রুবতারাকে আরও বিশেষ করে তোলে।

বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ আসিফ বলেন,  নীল আকাশে ধ্রুবতারার মতোই কিছু ভালোবাসা চিরন্তন—আমার জন্য সেই ভালোবাসার নাম ধ্রুবতারা। ২০২০ সালে ক্যাম্পাসে পা রাখার পর থেকে দেখেছি অনেক পরিবর্তন, তবে ধ্রুবতারার প্রতি সবার নিখাদ ভালোবাসা কখনো বদলায়নি। এই সংগঠন আমাকে গড়ে তুলেছে, দায়িত্ববান করেছে, শিখিয়েছে মানুষ ও সময়কে মূল্য দিতে, আস্থার জায়গা তৈরি করতে। এখানে পেয়েছি অসাধারণ কিছু মানুষ, যাদের সান্নিধ্য ও অভিজ্ঞতা আমার সারাজীবনের সম্পদ। আমি চাই, ধ্রুবতারা তার আলো ছড়িয়ে যাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, হোক স্বার্থহীন ভালোবাসার এক ঠিকানা।” 

সাধারণ সম্পাদক সুদিপা সরকার বলেন, “ধ্রুবতারা পরিবার এখন একশত সদস্যের প্রাণবন্ত সংগঠন, যেখানে অভিজ্ঞ ও নবীনরা একসঙ্গে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা করছে। বর্তমান ত্রয়োদশ কার্যকরী কমিটির ৭৫ জন সদস্য নিষ্ঠা ও উদ্যম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, রিলস ও টিকটকের যুগে সৃজনশীলতা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যেও আমাদের সদস্যরা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা মাভাবিপ্রবির গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশজুড়ে এই সাংস্কৃতিক ধারা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। ধ্রুবতারার প্রকৃত সার্থকতা হলো শুদ্ধ, মননশীল সংস্কৃতি গড়ে তোলা ও তা টিকিয়ে রাখা। অতীতের মতো বর্তমান সদস্যরাও এই আদর্শ বহন করবে—এটাই আমাদের অঙ্গীকার।”


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence