বশেমুরবিপ্রবিতে নিয়ম ভেঙে শিক্ষককে পদোন্নতি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) এবার এক শিক্ষকের সহকারী অধ্যাপক হতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে থাকতে হবে চার বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. হাসিবুর রহমানকে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে এ শর্ত ভঙ্গ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চার বছর শিক্ষকতার পূর্বেই তাকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করেছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার বিষয় থাকায় ড. হাসিবুর রহমান সময়ের আগেই পদোন্নতি নেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং উপাচার্যের সাথে ভালো সম্পর্কের জেরেই উপাচার্য তাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দিয়েছেন। এর পাশাপাশি উপাচার্য শিক্ষকদের মতামত উপেক্ষা করে তাকে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্যও বানিয়েছেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে চেকের মাধ্যমে বিভাগের অর্থ আত্মসাৎ, প্রশ্নফাঁস এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ থাকলেও সেসব অভিযোগের সত্যতার বিষয়ে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তা।

এ নিয়ে ড. হাসিবুর রহমান বলেন, একজন কর্মচারী চেক চুরি করে পরবর্তীতে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিল এবং প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অভিযোগকারী প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি স্বীকার করেছেন, এটি ভুল বোঝাবুঝি ছিল—এসব বিষয়ে তদন্তের প্রশ্নই ছিল না।

আরও পড়ুন: বশেমুরবিপ্রবিতে ‘ছাত্রী হয়রানি’তে অভিযুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ

এর আগে বিগত ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বশেমুরবিপ্রবিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. হাসিবুর রহমান। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। তবে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চার বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির আবেদন করেন এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত রিজেন্ট বোর্ডের সভায় সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অনুমোদন করা হয় তার পদোন্নতির বিষয়টি। 

অভিযোগ রয়েছে, হাসিবুর রহমান সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ৩ বছর ১ মাস কর্মরত থেকেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষকের অভিজ্ঞতাকে সহকারী অধ্যাপকের সমমান দেখানো হয়েছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেতে চার বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়াও তিনি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালেও—তিনি আড়াল করেছিলেন শাস্তির বিষয়টি। 

এছাড়া ড. হাসিবুর রহমান গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকায় বহিষ্কৃত ছিলেন ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে। এরপর এ ঘটনায় লিখিতভাবে ক্ষমা চাওয়ার প্রেক্ষিতে একই বছরের মার্চে তাকে পুনর্নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে পদোন্নতির আবেদনপত্রে বহিষ্কার থাকাকালীন সময়সহ অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন তিনি। ড. হাসিবুর রহমানের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপত্রেও বহিষ্কার সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন: মাভাবিপ্রবিতে শিক্ষক নিয়োগে উপাচার্যের ‘স্বেচ্ছাচারিতায়’ বাদ পড়েছেন যোগ্যরা

ড. হাসিবুর রহমানের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি জানিয়েছেন, শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য ড. হাসিবুর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক প্রায় তিন মাস বহিষ্কার ছিলেন এবং ২০১৬ সালের মার্চে তারা পুনরায় যোগদান করেন। 

অভিযোগের বিষয়ে ড. হাসিবুর রহমান বলেন, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন প্রায় চার বছর আমাদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছিল না। বিষয়টি নিয়ে আমরা কয়েকজন মিটিং করার জেরেই আমাদের তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়। তবে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং আমাদের ওই কয়েকমাসের বেতনও ফিরিয়ে দেয়।

তিনি বলেন, যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাই তাদের বিধি অনুযায়ী আমাদের লিখিত ক্ষমা চেয়ে চাকরিতে যোগদান করতে হয়। আর গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে যে অভিজ্ঞতা সনদ দেয়া হয়েছে সেখানে তারা ওই মাসগুলোসহই সনদ দিয়েছেন এবং আমি সেই অনুযায়ীই অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছি।

আরও পড়ুন: বেরোবিতে জোবেদার ‘ডাক না পাওয়া নিয়োগে’ শিক্ষক হলেন ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল

শর্ত পূরণ না করেই সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার প্রসঙ্গে এই শিক্ষক বলেন, আমি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বছর শিক্ষকতা করেছি। এর মধ্যে প্রায় তিন বছর সিনিয়র প্রভাষক ছিলাম। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা অর্ধেক কাউন্ট হলেও ৫ বছর অভিজ্ঞতা হয়। সিনিয়র প্রভাষক সহকারী অধ্যাপকের ইকুইভ্যালেন্ট কিনা—এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না। এটি প্লানিং কমিটি এবং উপাচার্য বলতে পারবেন।

একজন আবেদনকারী হিসেবে আমি বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ করে আবেদন করেছিলাম। এই বিবেচনার অনুরোধ আমি করতেই পারি। এখন তারা কীভাবে, কীসের প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনা করেছেন সেটি তারাই ব্যাখ্যা দিতে পারবেন—যুক্ত করেন তিনি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সভাপতি এবং প্লানিং কমিটির প্রধান ড. মো. আবু সালেহ বলেন, আমরা সিনিয়র লেকচারার সহকারী অধ্যাপকের সমমান বা সমমান নয়—এমন কিছুই বলিনি। আমরা আবেদনের বিষয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম।

আরও পড়ুন: ‘টাকা ছাড়া এমপিও হয় না’—মতিঝিল মডেল কর্তৃপক্ষের অডিও ফাঁস

আর বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য ড. একিউএম মাহবুব বলছেন, সিনিয়র প্রভাষক সহকারী অধ্যাপকের ইকুইভ্যালেন্ট (সমমান) ধরা যায়। একজন শিক্ষক ১২ বছর প্রভাষক থাকবেন নাকি? তার পিএইচডি ডিগ্রি আছে, আর্টিকেল আছে—সেজন্য তিনি পদোন্নতি পেতেই পারেন।

উপাচার্যের কাছে সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির অতীত তুলে ধরে বলেন, আগে তো বিএসসি অনার্সও ছিল, শুধু বিএ পাস করা ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, কর্মকর্তা থেকে লেকচারার বানানো হয়েছে। আগে এরচেয়েও খারাপ হয়েছে।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বলছে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ রয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষক পদকে সহকারী অধ্যাপক সমমান দেখানোর সুযোগ নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিয়মের ব্যত্যয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে বলেও মত কমিশনের।

আরও পড়ুন: সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জাতীয় র‍্যাঙ্কিংয়ের সুপারিশ ইউজিসির

বিষয়টি নিয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ রয়েছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষক পদকে সহকারী অধ্যাপককে সমমান বলার সুযোগ নেই। যদি এমন হত যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সহকারী অধ্যাপক পদই নেই—তখন বিষয়টি বিবেচনা করা যেত।

ইউজিসির আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. মো. তাহেরের মতে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি কোনো একজনের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে বা নিয়মে ছাড় দেয় তাহলে পরবর্তীতে আরও অনেকেই এ ধরনের সুযোগ চাইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সিস্টেমই তখন ভেঙে পড়বে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত নীতিমালা যেমন রয়েছে সেই অনুযায়ীই সবকিছু পরিচালনা করা।


সর্বশেষ সংবাদ