গ্রাজুয়েট ও রিকশাচালক বাবা-ছেলে নয়
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:৪৯ PM , আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৪:৩১ PM
“নিজে রিক্সাচালক, তবে সন্তান তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। গর্বে মুখে তাঁর প্রশস্ত হাসি। সন্তানের হাত ধরে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’’ সম্প্রতি এমনই একটি ক্যাপশন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি প্রকাশ করেছে শাহরিয়ার সোহাগ নামে এক তরুণ। কিন্তু ছবিতে দেখা ব্যক্তিদ্বয় আসলেই কি বাবা-ছেলে? জবাবটা নিজেই দিয়েছেন ভাইরাল হওয়া ছবির নায়ক গ্র্যাজুয়েট লিটন মোস্তাফিজ ও ফটোগ্রাফার। চলুন জানা যাক-
সমাবর্তনের গাউন পরিয়ে রিকশাচালককে স্যালুট দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। ছবিটি দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ছবির দু'জনকে বাবা-ছেলে পরিচয় দিয়ে অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। একজনের স্ট্যাটাস ছিল এরকম, 'এটি কনভোকেশনের সেরা ও শ্রেষ্ঠ ছবি। নিশ্চিত সে পৃথিবীর সব থেকে সুখী পিতা, নিজে রিকশা চালিয়ে সন্তানকে পড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। স্যালুট গর্বিত পিতা ও তাঁর সন্তান কে।'
ভাইরাল হওয়া ছবির গ্র্যাজুয়েট লিটন মোস্তাফিজ। তবে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আমরা বন্ধুরা মিলে অনেক ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ দেখি পাশে রিকেশাওয়ালা চাচা আমার দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে তার গায়ে আমার গাউন পরিয়ে দেই। এ সময় কয়েকটি ছবি তোলা হয়। ভাইরাল কিংবা বাহবা পাওয়ার জন্য ছবি তুলিনি। আমার বাবাও একজন কৃষক। শ্রমজীবীদের কষ্ট আমাকে নাড়া দেয়। তাদের প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। যিনি ছবি তুলেছিলেন তার পেজে পোস্ট দেওয়ার পর মুহূর্তেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ছবি নিয়ে যখন বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন আমি ফেসবুকে আমার বক্তব্য তুলে ধরি।
তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি ছিল এরকম...
'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে এ ছবির একটি বিশেষ অংশ গতকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছবির ঐ অংশটি সম্ভবত বিভিন্ন গ্রুপ হয়ে ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ফটোগ্রাফার শাহরিয়ার সোহাগ গতকাল অপরাজেয় বাংলার সামনে থেকে এ ছবিটি তোলেন। রিকশায় যিনি বসে আছেন তিনি আমাদের গর্বিত একটি অংশ। মনেই হয়নি সে মুহূর্তে তিনি অন্য একটি অংশ। পৃথিবীর আর সব বাবার মতো এ বাবার চোখেও আমি স্বপ্ন খুঁজে পাই। মোটেও মনে হয় নি তার গায়ের ঘাম লাগলে দুর্গন্ধী হয়ে উঠবে আমার গাউন। এমন ঘামের চর্মশরীরে বেড়ে ওঠা আমার। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর চাকা এ 'পিতা'দের ঘামে ও দমে ঘোরে।
আমরা যখন খুব আনন্দ করছিলাম তখন তিনি আনমনা নজরে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিষয়টি আমি বুঝে 'পিতা'কে ডাক দেয়। তিনি সাড়া দেন। আমি আমার গাউন, হুড খুলে 'পিতা'কে পরিয়ে দেই। তারপর ছবি তোলা হয়। একজন গর্বিত গ্রাজুয়েট মনে হচ্ছিলো তখন আমার। এঁদের রক্ত ঘামানো অর্থেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পেরেছি। এ 'পিতা'র পোশাক দেখে স্যালুট না করে পারি নি। এ ছবি তুলে রাতেই ফেইসবুকে পোস্ট করেন ফটোগ্রাফার। ছবিটি ভাইরাল হলে দেখা যায় অনেকেই আমাকে ভুল বুঝছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিটি নিউজ হয়ে গেছে। দুঃখিত আমি যে মুখ ঘোলা করার জন্য তবুও বলি, এসব মানুষের মাথা খালি বলেই আমাদের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হুড! যাঁরা ভুল বুঝেছেন আমি তাঁদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি ফটোগ্রাফারের হয়ে। এসব মানুষেরা আমাদের সত্যিকার বাবা-ই। কারণ আমি নিজেও কৃষকের লাঙলের ফালা বেয়ে উঠে এসেছি...'
এদিকে ওই ছবিটি যিনি তুলেছেন সেই শাহরিয়ার সোহাগও ছবিটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজের ফেসবুকে। তিনি লিখেছেন, 'প্রোফেশনালি কিংবা শখের বসে ছবি তোলা আমার নেশা। লেখালেখি করি বিধায় কৌতূহলটাও বেশি। ক্যামেরা নিয়ে সেদিন ঘুরতে থাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার মামা লিটন মোস্তাফিজ ও তার বন্ধুরা সমাবর্তন উদযাপন করছিল। তাদেরও কিছু ছবি তুললাম।
অপরাজেয় বাংলার সামনে আসতেই একজন বৃদ্ধ রিকশায় বসে অনেকক্ষণ টুপি উড়ানো দেখছিলেন। কৌতূহল নিয়ে কাছে গেলাম আমি আর মামা। "তাঁর ছেলেও নাকি পাস করেছে।" আমি বিস্তারিত অনুসন্ধান কিংবা জেরা করার প্রয়োজন মনে করিনি। কারণ এমন ঘটনা এখন অহরহ। গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরাই এই গ্রাজুয়েটের একটা বড় অংশ। উনার সন্তান সমাবর্তন টুপি পরেছেন বা পরবেন সে যাই হোক, উনি একজন বাবা। তারও সন্তান আছে। আর আজ যারা গ্রাজুয়েট তারাও কোনো না কোনো বাবার সন্তান। অনেককে শুনেছি তাকে বাবা বলে সম্বোধন করতে। আর এত মানুষের বাবা ডাকে উনি তখন আবেগাপ্লুত।
আমি আমার তোলা কয়েকটা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করি। অনেকে অনেক ভাবেই ছবিগুলোতে অতিরঞ্জিত ক্যাপশন ব্যবহার করেছেন। অনেকে আবার ছবি নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেছেন। নিজের ভালো লাগার জায়গা থেকে ছবিগুলো পোস্ট করার পর ছবিগুলো রীতিমতো ভাইরাল।
আলোচনা কিংবা সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে গ্রাজুয়েট ভাবুন আর বৃদ্ধর ক্লান্ত মুখে নিজের বাবাকে কল্পনা করুন। বাবারা তো একই রকম হয়। আলাদা শুধু চেহারাটা। সব বাবাদের ভেতরটা একই রকম। এখন থেকে রিকশায় উঠলে কিংবা যে কোনো কাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের যেন সম্মান করি। কারণ আমাদের বাবারা আমাদের কারো কাছ থেকেই যেন কষ্ট না পান। সব বাবারা ভালো থাকুক। এপারে কিংবা ওপারে।'