ঘুমন্ত অধিনায়কই ঘুম ভাঙালেন দক্ষিণ আফ্রিকার, ঘোচালেন ‘চোকার্স’ অপবাদ

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক মেইস বা গদা হাতে টেম্বা বাভুমা
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক মেইস বা গদা হাতে টেম্বা বাভুমা  © এএফপি

মাঠ ও মাঠের বাইরে এতদিন ‘চোকার্স’ বলতে দক্ষিণ আফ্রিকাকেই স্মরণ করতেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। তবে এবার সেই তকমা ঘুচাল প্রোটিয়ারা। ক্রিকেটের তীর্থস্থান লর্ডসে ‘চোকার্স’ অপবাদ ঘুচায় টেম্বা বাভুমার নেতৃত্বাধীন দলটি।

এতদিন কেপলার ওয়েসেলস, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, গ্যারি কার্স্টেন, শন পোলক, গ্রেম স্মিথসহ একাধিক শিরোপার দ্বারপ্রান্তে গিয়েও একরাশ হতাশাকে সঙ্গী করেই ফিরেছেন। তবে এবার বন্ধুর এক পথ পাড়ি দিয়েই বিজয়কেতন উড়াল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই জয়োল্লাসের অন্যতম নায়ক বাভুমা। অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে নতুন করে ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটের সিংহাসনে বসেছে তারা।

ক্রিকেটের তীর্থস্থানে বহু ইতিহাসই রচিত হয়েছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। লর্ডসের ব্যালকনিতে স্মরণকালের সেরাদের কাঁতারে নিজের নাম ওঠা দেখলেন বাভুমা। এদিন শেষ পর্যন্ত মাঠে ছিলেন না প্রোটিয়া অধিনায়ক। তবে চোট নিয়ে তার লড়াইয়ের মানসিকতাই বাড়তি অনুপ্রেরণা জোগায় দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে। হাঁটতে পারছিলেন না, তবুও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই দলের প্রয়োজনে ফিফটি পেরোনো ইনিংস খেলেন বাভুমা। লর্ডসে জয়ের সুবাদ বইয়ে ব্যক্তিগত ৬৬ রানে যখন ফিরলেন, তখন করতালিতে তাকে সম্মান জানান মাঠে উপস্থিত দর্শকরা। ধারাভাষ্যকারের মতে, ‘অবিশ্বাস্য ইনিংস।’

তবে শুধু প্রোটিয়া অধিনায়কই না, ২৭ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে শিরোপা জয়ের ম্যাচে এইডেন মার্করামের দুর্দান্ত ইনিংসও কালের বিবর্তনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন ক্রিকেটভক্তরা। জয় থেকে প্রোটিয়ারা ৬ রান দূরে থাকতে সাজঘরে ফেরেন মার্করাম। তবে এরই মাঝে সাজিয়ে ফেলেন ১৩৬ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস।

একটু পেছনে ফেরা যাক! সময়টা ২০১৬, সেদিন নিউল্যান্ডসের এসএসি জুনিয়র স্কুলে প্রথম টার্মের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের জন্য একটা লেখা নিয়ে এসেছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। লেখাটি মূলত স্কুলের পুরোনো একটি ম্যাগাজিনের। সেটাও ১৫ বছর আগের। ২০০১ সালে সিক্স গ্রেড-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বলে হয়েছিল, ‘‘১৫ বছর পর তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও, সে বিষয়ে লিখো।’’

সেদিন একটি ছেলে লিখেছিল, ‘১৫ বছর পর আমি নিজেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে দেখি, এজন্য মিস্টার এমবেকির (দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট) সঙ্গে করমর্দন করছি।’

সেই ছেলেটি আজকের টেম্বা বাভুমা। আর স্কুলে প্রধান শিক্ষক যখন ওই লেখাটা পড়ে শোনাচ্ছিলেন, এর ৪/৫ দিন আগে ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স ক্রিকেট ক্লাব মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস লিখে ফেলেন বাভুমা। দেশটির ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানের টেস্টে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়া।

এবার ২০২৫ সালের ১৪ জুন ফের ইতিহাস! সেটাও আবার প্রোটিয়াদের ইতিহাসে উপেক্ষিত অধিনায়কের হাত ধরেই। বারবার বড় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনাল থেকে একরাশ হতাশা আর অশ্রুজলে পরিসমাপ্তির উপাখ্যানে নাম উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকার। পুরো আসরজুড়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করা দলটি প্রতিবারই তীরে এসে তরী ডুবিয়েছে। তবে এবার সেটা হয়নি, নিজের শো কেসে ট্রফিই তুলেছে প্রোটিয়ারা।

আর এই জয় শুধু ট্রফিই নয়, প্রোটিয়াদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তও বটে। ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মত আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট জিতেছে তারা। সেবার নকআউট ট্রফি (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

এমন সাফল্যের পেছনেও ভিন্ন এক রসায়ন রয়েছে। সময়ে-অসময়ে নানান কটূক্তি কালিমা বাভুমাকে নিয়ে লেপন করা হয়েছে। সমালোচকদের চোখে, তিনি তো অধিনায়ক সুলভ ম্যাটেলিয়ারই না। খর্বকায় আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমত হাসিরপাত্র। সেই খাটো ক্যাপ্টেনই কি না আজ শিরোপা হাতে উল্লাস করছেন। এ যেন হাজারো বেদনায় মুড়ানোর একটি সফল প্রেম-কাহিনী। 

মনে আছে কি, বিশ্বকাপ শুরুর আগে ১০ অধিনায়ক নিয়ে ‘ক্যাপ্টেন্স ডে’র কথা। সঞ্চালকের দু’পাশ জুড়ে বসেছিলেন অধিনায়করা। সেখানে একজন বলছিলেন, আর বাকিরা শুনছিলেন। বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যখন আলোকপাত করছিলেন, সেই সময়েরই একটি ছবি! বাঁ-দিকে মাথা হালকা কাঁত করে ছিলেন বাভুমা, চোখ জোড়া বন্ধ। প্রথম দৃষ্টিতে, যে কেউই বলে উঠবেন বাভুমা ঘুমোচ্ছিলেন।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা রটেছে। অট্টহাসিতেও মেতেছিলেন অনেকে। যদিও পরে প্রোটিয়া অধিনায়ক জানিয়েছিলেন, তিনি মোটেই ঘুমাচ্ছিলেন না। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের কারণেই এমনটা মনে হয়েছে।

এবার ঘুমন্ত অধিনায়কই ২৭ বছরের ঘুম ভাঙাল দক্ষিণ আফ্রিকার। আর ফাইনালজুড়ে খর্বকায় বাভুমার লড়াই-ও ইতিহাস হয়ে থাকল। হ্যামস্ট্রিং চোট নিয়েও ৩৩ ওভার খেলেন বাভুমা। আর ‘কোটার ক্যাপ্টেন’ কিংবা ‘কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাপ্টেন’র প্রত্যাবর্তনেই ক্রিকেটপৃথিবীতে নতুন এক সিনেমার দেখা মিলল।


সর্বশেষ সংবাদ