আইন তুচ্ছ, পাহাড় ধ্বংসে বেপরোয়া কেইপিজেড

কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড)
কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড)  © টিডিসি

চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) আবারও নির্বিচারে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নতুন কারখানা স্থাপনের অজুহাতে দিনরাত পাহাড় কেটে সাবাড় করছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।

২০০৯ সালে হাইকোর্ট কেইপিজেডকে পাহাড় ‘ড্রেসিং’-এর সীমিত অনুমতি দিলেও পাহাড় বিলুপ্ত করার অনুমতি দেয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের পাহাড় কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে এবং শর্ত অনুযায়ী বনায়ন ও জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা, পরিবেশ আইনের বিধান এবং প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেইপিজেড বারবার পাহাড় কেটে চলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, এর আগে ২০১২ সালে পাহাড় কাটার অভিযোগে কেইপিজেডের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তারা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আনোয়ারার বৈরাগ এলাকায় কেইপিজেডের নতুন কারখানার জন্য খননযন্ত্র (এক্সকেভেটর) দিয়ে উঁচু পাহাড় কেটে মাটি অপসারণ করে সমতল করা হচ্ছে। পাহাড় কাটার ফলে দেয়াং পাহাড় ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। বাকি থাকা টিলা-পাহাড়গুলোও সমান করে নতুন কারখানা, রাস্তা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাহাড় কাটার কারণে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে নেমে আসায় ফসলের ক্ষতি এবং মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আনোয়ারা-কর্ণফুলী এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণে ২২ জন নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।

কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান দাবি করেছেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত কারখানা নির্মাণের কাজ চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই পাহাড় সমতল করা হচ্ছে। পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সে দিকটি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।’

তবে তিনি কী ধরনের অনুমতি পেয়েছেন এবং কতটুকু এলাকায় কার্যক্রম চালানোর অনুমতি আছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মো. মঈনুদ্দিন ফায়সাল বলেন, ‘ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ টিম পাঠানো হচ্ছে। তারা নিরীক্ষা করবে কেইপিজেড কতটুকু অনুমতি নিয়ে কাজ করছে এবং কতটুকু এলাকার মাটি কাটা বৈধ। আপাতত কেইপিজেডকে মাটি কাটার কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, অনুমোদনের সীমা লঙ্ঘন করা হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কেইপিজেডের ইতিহাস ও পরিবেশ সংরক্ষণ সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে বেসরকারি ইপিজেড আইন অনুযায়ী কেইপিজেড ২,৪৯২ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়। সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী, ৩৩% জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে বনাঞ্চল গড়া, ১৯% জমি জলাধার বা ফাঁকা জায়গা রাখা। তবে, ৮৪০ একর জমিতে কারখানা নির্মাণ অনুমোদিত ছিল।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই শর্তগুলো নানাভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। এমনকি বিগত সময়ের সরকার কয়েকবার তাদের জমির মালিকানা সংকুচিত করার উদ্যোগও নেয়।

পরিবেশবিদ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশ্ন- কেইপিজেডের নামে কি পরিবেশ হত্যার বৈধ সনদ দেওয়া হয়েছে?

তাঁরা জানান, আনোয়ারা-কর্ণফুলীর পাহাড়ি এলাকা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার নয়, এটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও। এখানে অব্যাহত পাহাড় কাটা জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিধস, খরা ও বন্যার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান যে হারে পাহাড় কাটা চলছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!