চার উপজেলার রোগীর চিকিৎসায় একজন চিকিৎসক
- মো. নাঈম হাসান ঈমন, ঝালকাঠি
- প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৫ AM , আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৫ AM

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৪ জন মেডিকেল অফিসারের অনুমোদিত পদ থাকলেও বর্তমানে একজনও কর্মরত নেই। একজ ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) দিয়ে কোনওমতে চালানো হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রাজাপুরসহ চার উপজেলার রোগী। অনেকেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন বাড়িতে। বাড়তি খরচ করে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে।
১৯৭০ সালে নির্মিত রাজাপুর উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি আশপাশের ভান্ডারিয়া, কাউখালি ও কাঁঠালিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে। ফলে এ তিন উপজেলার মানুষও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ জন বহির্বিভাগের রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন এবং ভর্তি থাকেন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী। টিকিট কাউন্টার এবং চিকিৎসকের রুমে থাকে বড় লাইন।
বর্তমানে এই বিশাল দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র তিনজন কর্মকর্তা। ভারপ্রাপ্ত আরএমও ডা. তমাল একাই সকাল-বিকেল ভর্তি রোগীদের দেখভাল করেন। বহির্বিভাগের রোগীদের চিকিৎসাও দিচ্ছেন। তার পাশাপাশি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের মাহামুদ এবং আয়ুর্বেদিক ও ন্যাচারাল মেডিসিন শাখার মো. হাসিবুল হোসাইন চিকিৎসা কার্যক্রমে সহায়তা করছেন। এভাবে সীমিত জনবলে চলছে পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
কাঁঠালিয়া উপজেলার সাতানি বাজার এলাকা থেকে শরীরের ব্যথা নিয়ে ৯০ বছর বয়সী মনীন্দ্র হালদার আরএমও ডা. তমাল হালদারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। তিনি বলেন, ‘সকাল ৮টায় এসে টিকিট কেটে সিরিয়ালে বসে আছি। এখন সাড়ে ১১টা বাজে, কিন্তু ডাক্তার দেখাতে পারিনি। কবে সিরিয়াল পড়বে, সেই অপেক্ষায় বসে আছি।’
চিকিৎসক সংকট এতটাই প্রকট যে, জরুরি বিভাগে কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তার মাধ্যমেই পরিচালনা করতে হচ্ছে সেবা কার্যক্রম। হাসপাতালে রয়েছেন দুজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং গাইনির একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট। তবে বহির্বিভাগের রোগী দেখতে পারেন না।
পর্যাপ্ত সংখ্যক নার্স থাকলেও চিকিৎসক না থাকায় কার্যকর সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এছাড়া হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনটি ছয় বছর ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে টেকনোলজিস্ট না থাকায়। ফলে মাত্র ১৫০ টাকায় এক্স-রে করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৩০০-৩৫০ টাকা দিয়ে খরচ করতে হচ্ছে।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হাসান হাফিজুর রহমান দায়িত্বে আসায় দেড় বছর ধরে রক্ত পরীক্ষার কিছু কার্যক্রম চালু হয়েছে। তবে রাসায়নিক দ্রব্যের অভাবে এখনও লিপিড প্রোফাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা জানতে রোগীদের বাইরের পরীক্ষা নির্ভর করতে হচ্ছে।
মেডিকেল টেকনোলজিস্টের চারটি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র একজন। হাসপাতালটিতে আল্ট্রাসনো মেশিন থাকলেও অভিজ্ঞ জনবল না থাকায় সেটিও ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তবে এই সীমাহীন সংকটের মাঝেও হাসপাতালের নিচতলায় ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য একটি আলাদা কর্নার চালু রয়েছে, যেখানে সরকারিভাবে ইনসুলিন ও অন্যান্য ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
কাউখালি উপজেলা থেকে মোসা. জান্নাতি তার ছেলের ভাঙা হাত নিয়ে এসেছেন চিকিৎসা করাতে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন চালু না থাকায় বাইরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৩০০ টাকা দিয়ে এক্স-রে করাতে হয়েছে। যদি হাসপাতালে মেশিনটি চালু থাকতো, তাহলে কম খরচে করা যেত।’
একই অভিযোগ শিয়ালকাঠি থেকে হাঁটুর সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা মোসা. বিউটি বেগমেরও। তিনি বলেন, ‘এক্স-রে মেশিন বন্ধ থাকায় বাইরে ৩০০ টাকা দিয়ে করতে হচ্ছে। অথচ হাসপাতালে এক্স-রে চালু থাকলে ১৫০ টাকায় হতো। গরিব মানুষের জন্য এটা অনেক উপকার হতো।’
বাদুরতলা এলাকা থেকে ৮০ বছর বয়সী শেফালী বেগম কাশির সমস্যা নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়াল দিয়ে বসে আছি।’ আদাখোলা এলাকা থেকে খাদিজা বেগম, চর সাংগর এলাকা থেকে ফরিদ মীরা, শ্রীপুর এলাকা থেকে মাহিনুর বেগম ও পারভীন বেগমসহ আরও অনেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসে একই ধরনের কথা বলেন।
তাদের ভাষ্য, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এলাকার মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখানে একজন চিকিৎসকও নেই। অবিলম্বে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হোক। যন্ত্রপাতি সচল করে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবিও জানান তারা।
আরো পড়ুন: ঢাবিতে ‘প্রেমিকযুগলের প্রতারণা সিন্ডিকেট’, বোকা বনলো উপদেষ্টা থেকে ছাত্রলীগ পর্যন্ত!
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, চিকিৎসক সংকট, যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা এবং জনবল ঘাটতির কারণে রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যত এখন আর হাসপাতাল নয়। এক রকম ‘জোড়াতালির ক্লিনিক’। যেখানে রোগীরা ভরসা হারাচ্ছে, চিকিৎসা খরচে দিশেহারা হচ্ছে এবং সরকারি সেবার আশা ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক আর শহরের বড় হাসপাতালে ছুটতে বাধ্য হচ্ছে। এই সংকট নিরসনে জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিকিট বিক্রেতা মো. সাইদুর রহমান বলেন, সব থেকে বেশি রোগী আসে বৃহস্পতিবার ও রবিবার। কারণ এই দু’দিন রাজাপুর বাঘড়ি সাপ্তাহিক বাজারের দিন। বোগীরা যে সকল সমস্যা নিয়ে আসেন, সেসব সমস্যার ডাক্তার এখানে না থাকায় অনেককে ফেরত যেতে হয়।
ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তমাল হালদার বলেন, প্রতিদিন দুই বেলা ভর্তি রুগী দেখতে হয়। এছাড়া বহির্বিভাগে রোগী অনেক বেশি আসে। মেডিকেল অফিসার না থাকার কারণে একার সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে। সব দিক একা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
রাজাপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের মাহামুদ রাসেল বলেন, হাসপাতালের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা বার বার উর্ধতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। অল্প কয়দিন হলে সামলানো যায়। কিন্তু এ সমস্যা ৫ মাসের বেশি। আমাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন অনলাইনে হাসপাতালের রিপোর্ট দেখে আমাদের কতজন রোগী আসে কতজন রুগী ভর্তি থাকে এবং আমরা কতজন ডাক্তার কর্মরত আছি। তারা দেখার পরেও কোন ব্যাবস্থা নিচ্ছে না।