টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘বিদ্যাবাড়ি পাঠাগার’
- সুজন চন্দ্র দাস, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৪:২৬ PM , আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫, ১২:৫১ PM

গ্রামের মাটিতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কয়েকজন সহপাঠী নিয়ে এক অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছেন জাকির হোসেন। তার বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি ২০২৩ সালের ২৮ মে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিদ্যাবাড়ি পাঠাগার’। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাকির হোসেন। পাঠাগারটির মূল উদ্দেশ্য গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলা ও একটি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণ।
জাকির হোসেন টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার মান্দারজানী গ্রামের সন্তান। এই গ্রামটি টাঙ্গাইল শহর থেকে ২২ কিলোমিটার এবং বাসাইল উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাঠাগার না থাকায় গ্রামের অনেকেই জ্ঞানচর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। এ অভাব পূরণ করতেই মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন গড়ে তুলেছেন এই পাঠাগারটি।
মাত্র ১৮টি বই নিয়ে শুরু হওয়া এই পাঠাগারে এখন কয়েক শ বই রয়েছে। পাঠ্যবই, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের বই এখানে পাওয়া যায়। প্রতিদিন গ্রামের শিশুরা, তরুণরা ও প্রবীণরাও এসে বই পড়েন, নতুন কিছু জানার চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন: স্বপ্নপূরণে ঈদে বাড়ি ফিরছেন না বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী
পাঠাগারটি শুধু বই পড়ার স্থান নয়, এটি এখন গ্রামের শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। এখানে তারা একসঙ্গে পড়াশোনা করে, আলোচনা করে এবং জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। নিয়মিত শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেরও আয়োজন করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করছে।
সদস্যরা প্রতি মাসে সর্বোচ্চ দুটি বই বাসায় নিয়ে পড়তে পারেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে হয়। জ্ঞানচর্চার সুযোগ বাড়াতে প্রতিদিনের সংবাদপত্র ও মাসিক ম্যাগাজিন রাখা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন, কুইজ, উপস্থিত বক্তৃতা ইত্যাদির আয়োজনও করা হয়। পাঠাগারে ১২টি আসন, ২টি টেবিল, পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসেরও ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে পাঠকেরা স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়তে পারেন।
পাঠাগারটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে জাকির হোসেন চান কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা সংযোজন করে ডিজিটাল শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করতে। ভবিষ্যতে স্থায়ী ফান্ড তৈরি করে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আরও পড়ুন: ডাকসু গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রস্তুত, চূড়ান্ত হতে পারে আগামী সপ্তাহে
জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, গ্রামের তরুণ প্রজন্ম স্মার্টফোনের অপব্যবহার, খেলাধুলা ও শারীরিক ব্যায়াম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে মুক্ত জ্ঞানচর্চার সুযোগ দিতে পারলে তারা মানসিকভাবে বিকশিত হবে। এ লক্ষ্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ আমার পাঠাগারের উদ্যোগটি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে এটিকে আরও বড় ও পরিপূর্ণ রূপ দিতে চাই। এ জন্য সমাজের শিক্ষানুরাগী ও সহৃদয়বান মানুষদের সহযোগিতা কামনা করছি।’
শুরুতে পাঠাগারে বইসংখ্যা কম থাকলেও এলাকার চাকরিজীবী, সচেতন ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা বই ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে চলেছেন। প্রথমে একটি চিঠির মাধ্যমে তাদের অবগত করা হয়, এরপর তারা বই কিংবা আর্থিক সহায়তা করেন।
আরও পড়ুন: মহামারির সময় যে হাসপাতাল রোগীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে
বিদ্যাবাড়ি পাঠাগারে নিয়মিত পড়তে আসেন সীমান্ত হাসান, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে আগে কোনো পাঠাগার ছিল না। পড়ার বাইরে সময় কাটানোর ভালো কোনো জায়গাও ছিল না। বিদ্যাবাড়ি পাঠাগার চালু হওয়ার পর আমি নিয়মিত এখানে আসি। এখানে নানা ধরনের বই আছে, যা আমাদের পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাঠাগারে আসার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, এখানে আমরা একসঙ্গে বসে পড়তে পারি, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারি। অনেক সময় যেসব বিষয় ক্লাসে বুঝতে পারি না, সেগুলো বন্ধুরা একে অপরকে বুঝিয়ে দেয়। এই বিষয়ে জাকির ভাইও সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া এখানে নিয়মিত কুইজ প্রতিযোগিতা, আর বই পড়ার প্রতিযোগিতা হয়, যা আমাদের আরও বেশি শিখতে অনুপ্রাণিত করে। আমি চাই, এই পাঠাগারটি আরও বড় হোক, যাতে আরও বেশি শিক্ষার্থী এখানে আসতে পারে।’
আরও পড়ুন: ভুল তথ্য দিয়ে চাকরি স্থায়ী করার অভিযোগ ঢাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে
গ্রামের তরুণদের জন্য ‘বিদ্যাবাড়ি পাঠাগার’ এক নতুন আশার আলো। এটি শুধু একটি পাঠাগার নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে জাকির হোসেনের এই প্রচেষ্টা যথাযথ সহায়তা পেলে টাঙ্গাইলের শিক্ষার বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে।
‘বই-পুস্তকে যদি ভালোবাসা হয়, মন সিন্দুক তবে হবে আলোময়’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে ওঠা এই পাঠাগারটি আগামী দিনে আরও বড় পরিসরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবে, এটাই প্রত্যাশা করেন জাকির।