অমর একুশে বইমেলায় নিরাপত্তার নড়বড়ে অবস্থা

গেটে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও যে যার মতো ঢুকছে বইমেলায়
গেটে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও যে যার মতো ঢুকছে বইমেলায়  © টিডিসি ফটো

নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের গল্পের বই ‌‌‘চুম্বন’ প্রদর্শন করায় গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় অমর একুশে বইমেলায় সব্যসাচীর ১২৮ নং স্টলে বিশৃঙ্খলা করেছে একদল যুবক। ঘটনার আগের দিন থেকেই মেলায় এই বই প্রদর্শনের বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি করেছেন নেটিজেনরা। সব্যসাচীর প্রকাশক সানজানা মেহেরান বিশৃঙ্খলার আগে থেকেই হুমকি পাওয়ার অভিযোগ তুলেন।

একদিন আগে থেকে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকার পরেও প্রতিরোধমূলক আগাম কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে। 

আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সানজানা মেহেরান জানান, প্রতি বছর তিনি তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ করেন এবং বইমেলায় বিক্রি করেন। তবে বাংলাদেশে তসলিমার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি কিছু হুমকিও পান। তবে অতীতে সেগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। এ বছরও তিনি তসলিমার ‘চুম্বন’ বইটি প্রকাশ করেছেন এবং এরপর থেকে একের পর এক হুমকীবার্তা আসছে তার কাছে।

অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছেন, মেলার শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাদের না। এর দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর।

এদিকে মেলায় প্রবেশপথে গত বছরের মতো কড়া নিরাপত্তাও দেখা যায়নি। যারা ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করছেন, পুলিশ শুধু তাদেরকে চেক করছেন। আজ সশরীরে মেলায় প্রবেশে কোনো বাঁধা পাননি এই প্রতিবেদক।

নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বইমেলায় ব্যাগ নামমাত্র চেক করা হয়। এছাড়া একেবারে নামেমাত্র দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশ। কাল তিনবার ঢুকলাম। কোনোরকম চেকিং হয় নাই।’ 

সরেজমিনে দেখা যায়, স্কুল কলেজের নির্দিষ্ট পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছাত্ররা প্রবেশ করার সময় তাদের ব্যাগও চেক করা হয় না।

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বইমেলায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমড়া কাঠের ঢেঁকি বলবে, যারা বই পড়ে তারা নাশকতা করবে, আমি তা ভাবিনি।’

তসলিমা নাসরিনের বইয়ের পর এবার সপ্তাহখানেক ধরে সমালোচিত হয়ে আসছে লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা বই ‘মূর্তিভাঙা প্রকল্প’ ঘিরে। মেলায় আবারও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকায় বইটি ইতোমধ্যে সরিয়ে নিয়েছে জ্ঞানকোষ প্রকাশনী।

মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইটির ৩৯তম পাতায় একটা হাদিসের রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘যুদ্ধবন্দি নারীদের ধর্ষণ করা বৈধ: তিরমিযি ১৫১০।’

অন্যদিকে তিরমিযি শরীফের ১৫১০ নং হাদিসকে বিকৃত করার অভিযোগ উঠেছে এই লেখকের বিরুদ্ধে। 

তিরমিযি শরীফের ১৫১০ নং হাদিসে কোরবানি নিয়ে রাসুল (স) এর নির্দেশনা আছে বলে জানা যায়। আর লেখক দাবি করেন, বিভিন্ন সংকলনের কারণে হাদিসের ক্রমিক ভিন্ন হতে পারে। 

লেখক নিজেই আসল হাদিসটি শেয়ার করেছেন। কিন্তু তিনি তার নিজের মতো করে অর্থ করে নিয়েছেন। 

আসল হাদিসটি: “উম্মু হাবীবা বিনতে ইরবায ইবনে সারিয়া (রা) থেকে বর্ণিত। তার পিতা (ইরবাষ) তাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) গর্ভবর্তী যুদ্ধবন্দিনীদের সঙ্গে গর্ভমোচন না হওয়া পর্যন্ত সংগম করতে নিষেধ করেছেন।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামে যুদ্ধবন্দিদের সাথে সুনির্দিষ্ট আচার বিধি রয়েছে। সেখানে ইন্টারকোর্সের বিষয় আছে। কিন্তু ইন্টারকোর্স আর ধর্ষণ এক জিনিস না। লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ইসলামকে ডিহিউম্যানাইজ করতেই ‘ধর্ষণ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে হাদিসটি বিকৃত করেছেন।

এভাবেই শান্তিপ্রিয় মানুষজনকে উস্কে দিতে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের এক শিক্ষার্থী।

মেলায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ আজম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এই ধরনের ব্যাপারগুলোতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হয় না। যখন কোনো বইয়ের ব্যাপারে আপত্তি উঠছে, তখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা আছে, প্রক্রিয়া আছে, তারা সিদ্ধান্ত দেবে। সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমির যে মেলা পরিচালনা কমিটি আছে তারা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। একটা খুবই স্পষ্ট প্রক্রিয়া।’ 

রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আসার আগেই যদি কোন বিশৃঙ্খলা হয়ে যায় সেক্ষেত্রে মেলা পরিচালনা কমিটির ভূমিকা কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, মেলা রাষ্ট্রের বাইরে নয়। মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ পুলিশের। এখানে হাজার হাজার পুলিশ বাহিনীর লোক কাজ করছে। এটা ঐতিহ্য। এক দেড় মাস আগে থেকেই সব আয়োজন করা আছে। তাই মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। আমরা তাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি।’ 

বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত টাস্কফোর্সের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বইমেলার কিছু নীতিমালা আছে। টাস্কফোর্স দেখছে যে, এসব নীতিমালা লঙ্ঘন হয় কিনা।’


সর্বশেষ সংবাদ