‘নিয়মবহির্ভূতভাবে’ প্রভাষকের বেতন কাটার অভিযোগ উপাচার্যের বিরুদ্ধে

লোগো
লোগো  © ফাইল ছবি

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) প্রভাষক হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্রভাষক হিসেবে চাকরির জন্য আবেদন করেন খুকৃবির একোয়াকালচার বিভাগের প্রভাষক মো. হামিদুর রহমান। খুকৃবি কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ওই আবেদন করা হয়। তবে চাকরি ছাড়ার ৩০ দিন পূর্বে অব্যাহতিপত্র জমা দেওয়া হয়নি বলে ওই প্রভাষকের জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ড (জিপিএফ) থেকে একমাসের মূল বেতন কেটে নেওয়া হবে এমন একটি শর্ত তার অব্যাহতি আদেশনামায় আরোপ করেছে খুকৃবি প্রশাসন।

নিয়মবহির্ভূতভাবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তার বেতন কর্তনের ওই শর্ত আরোপ করেছেন খুকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম চৌধুরী। এমনটিই অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষক। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তার এক মাসের বেতন কাটা হয়েছে। হামিদুর রহমানের সঙ্গে প্রশাসন বা উপাচার্যের কোনো আক্রোশ নেই।

ভুক্তভোগী শিক্ষক হামিদুর রহমান বলেন, চাকরি ছাড়ার ৩০ দিন পূর্বে অব্যাহতিপত্র জমা দিতে হবে এবং জমা না দিলে একমাসের বেতন কেটে নেওয়া হবে এরকম কোনো নিয়ম বা আইন খুকৃবিতে নেই। আমার আগে ২০২২ সালে এবং পরে ২০২৪ সালে বেশ কয়েকজন শিক্ষক তাদের চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই খুকৃবি থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছেন। তাদের কারোর ক্ষেত্রেই এই শর্ত প্রয়োগ করা হয়নি। সেখানে আমার চাকরি স্থায়ী হওয়ার পরেও এই শর্ত আরোপের কোনো মানে হয় না।

‘‘আমি সকল নিয়ম মেনে খুকৃবি প্রশাসনের মাধ্যমেই বাকৃবির শিক্ষক হিসেবে চাকরির জন্য আবেদন করি। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি বাকৃবি রেজিস্ট্রার বরাবর খুকৃবি রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত একটি পত্র পাঠানো হয়। সেখানে লেখা ছিল যে, যদি আমি বাকৃবির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হই তাহলে সেখানে খুকৃবি কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি থাকবে না। অর্থাৎ তারা আমাকে শর্তমুক্ত করে দিয়েছেন। এতকিছুর পরে মূল বেতন কাটার শর্ত কীভাবে আসে!’’

হামিদুর রহমান বলেন, অব্যাহতি আদেশ পত্রে উল্লিখিত ওই শর্ত প্রত্যাহার করে জিপিএফের শতভাগ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য খুকৃবি রেজিস্ট্রার ডা. খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার বরাবর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি আবেদন পত্র পাঠিয়েছি। খুকৃবি রেজিস্ট্রার আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে বেতন কেটে নেওয়ার মতো কোনো আইন খুকৃবিতে নেই। আমার চাকরি স্থায়ী হয়েছে এবং প্রশাসনের অনুমতিতেই বাকৃবিতে আসার সকল কাজ করেছি। তাই বিনা শর্তে আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে পারব বলেও জানান রেজিস্ট্রার।

এরপর খুকৃবি উপাচার্য কারসাজি করে বেতন কেটে রেখেছেন। হামিদুর রহমান বলেন, আমি পরে জানতে পেরেছি যে খুকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম চৌধুরী নানাভাবে আমার করা আবেদনটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। বেতন কর্তনের কোনো নিয়ম না থাকার পরও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে অবৈধভাবে তিনি আমার বেতন কেটে নিয়েছেন। আমাকে হেনস্তা করার জন্যই তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন।

হামিদুর রহমান আরও বলেন, খুকৃবিতে চাকরিরত অবস্থায় আমি সেখানকার শিক্ষক সমিতির সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন বা দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে উপাচার্যের সাথে জোড় গলায় কথা বলতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি বলে আমার প্রতি হয়ত তার ব্যক্তিগত আক্রোশ জন্মেছে। এ কারণেই নিয়মের বাইরে গিয়ে উনি আমাকে এভাবে হয়রানি করছেন।

বেআইনি এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, খুকৃবিতে আমার নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগপত্রেও এরকম কোনো নিয়ম উল্লেখ করা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চাইলেই নতুন নিয়ম করে আমাকে সেটির অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। অতি শিগগিরই আমার এই সমস্যার সমাধান না করলে আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো।

খুকৃবি থেকে বাকৃবির কৃষি রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে আসা মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘৩০ দিন পূর্বে অব্যাহতি পত্র জমা দিতে হবে এমন কোনো নিয়ম খুকৃবিতে নেই। আমি যখন খুকৃবি থেকে চাকরিতে অব্যাহতি নিই তখন আমার ক্ষেত্রে এরকম কোনো শর্ত আরোপ করা হয়নি।’

খুকৃবি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আসা তানজিমা আক্তার বলেন, ‘৩০ দিন পূর্বে অব্যাহতি পত্র জমা না দিলে এক মাসের মূল বেতন কাটা হবে এমন কোনো লিখিত নিয়ম খুকৃবিতে আছে বলে আমার জানা নাই। আমার ক্ষেত্রে এরকম কোনো শর্ত বা বিষয় খুকৃবি প্রশাসন জানায়নি।’

ত্রিশ দিন পূর্বে অব্যাহতি পত্র জমা দেওয়ার শর্তের বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান মানিক বলেন, ‘চাকরিতে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হওয়ার এক মাস আগে কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব না যে সেই ব্যক্তি নির্বাচিত হবেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এরকম নিয়ম থেকেই থাকে তাহলে সেটা সকলের জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে। একজনকের জন্য শর্ত দিয়ে অন্যদের শর্তমুক্ত রাখার বিষয়টি চরম অন্যায়ের। অন্যদের ক্ষেত্রে শর্ত না দেওয়ার বিষয়টি যদি প্রশাসনের ভুলত্রুটির কারণে হয়ে থাকে তাহলে তার দায়ভার প্রশাসনের। তবে সকলের জন্য একই নিয়ম হওয়া প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে খুকৃবি রেজিস্ট্রার ডা. খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘খুকৃবি একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। একারণেই এখানে অনেক আইন লিপিবদ্ধ নাই। আমরা সরকারি সকল আইন মেনে চলি। সরকারের অডিটর জেনারেলের নিয়মানুযায়ী চাকরি ছাড়ার এক মাস পূর্বে না জানালে ওই ব্যক্তির এক মাসের মূল বেতন কেটে নেওয়ার আইন আছে। হামিদুর রাহমানের ক্ষেত্রে এই নিয়মটিই প্রযোজ্য হয়েছে। ভবিষ্যতে তাকে যে প্রভিডেন্ট ফান্ড দেওয়া হবে সেখান থেকে তার ১ মাসের বেতন কর্তনের শর্তে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। হামিদুর রহমানের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী আমরা শর্ত দিয়েছি।’

খুকৃবি থেকে অব্যাহতি নেওয়া অন্যান্য শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ১ মাসের বেতন কেটে নেওয়ার শর্ত না দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমাকে ওই আদেশ নামাগুলো দেখতে হবে। সকলের ক্ষেত্রেই শর্ত দেওয়া হয়। হয়ত কোনো ভুল ত্রুটিও হতে পারে এখানে। আদেশ নামায় কোনো ভুলত্রুটি থাকলে আমরা সেটি সংশোধন করে আবার পাঠানোর ব্যবস্থা করি। সরকারি নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।’

ডা. খন্দকার মাজহারুল আনোয়ারের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী হামিদুর রহমান বলেন, ‘অডিটর জেনারেলের যে নিয়মের কথা বলা হয়েছে সেটি আমার নিয়োগপূর্ব অনুমতিপত্রে কোথাও উল্লেখ করা ছিল না। ভবিষ্যতে এধরনের কোনো আইন হবে কিনা সেটি আমার দেখার বিষয় না। আমার চাকরির সময়কালীন এধরনের কোনো শর্ত আমার নিয়োগপত্রে দেয়নি খুকৃবি প্রশাসন। এটি যদি প্রশাসনের ভুল হয়ে থাকে তবে তার দায়ভার প্রশাসনের। আমাকে পূর্বশর্ত দিয়ে দিলে আমি অবশ্যই ৩০ দিন আগে অব্যাহতি পত্র জমা দিতাম।’

এ বিষয়ে খুকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি নিয়মানুযায়ী চাকরি ছাড়ার ৩০ দিন আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। ৩০ দিন পূর্বে না জানালে ওই ৩০ দিনের মূল বেতন কাটা যাবে। ১৫ দিন আগে জানালে বাকি ১৫ দিনের মূল বেতন কাটা যাবে। অডিটর জেনারেলের এই নিয়মটি সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরে আমরা এই শর্তটি দেওয়া শুরু করেছি। যেটা হামিদুর রহমানের অব্যাহতি আদেশ নামায় উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদের বিষয়ে একই আইন অনুসরণ না করার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ভুলবশত কারো কারো আদেশ নামায় এই শর্তটি বাদ পড়ে গেছে। বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত। শর্ত দেওয়া থাক বা না থাক সকলের জন্য একই নিয়ম কার্যকর হবে। এখনও কাউকেই টাকা দেওয়া হয়নি। টাকা দেওয়ার আগে সরকারি নিয়ম মেনে সকলের হিসাবনিকাশ করা হবে। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা অন্য কোনো বিষয়ই নাই। সরকারি নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়  প্রশাসনের নেই।


সর্বশেষ সংবাদ