বুয়েটে প্রথম হওয়া ছাত্রকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রল, ক্ষুব্ধ নেটিজেনরা যা বলছেন

ফেসবুকে ট্রল
ফেসবুকে ট্রল  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তাকে নিয়ে ট্রল (উপহাস করে পোস্ট) করা হয়েছে বলে দাবি নেটিজেনদের।

গত ১৯ মার্চ বুয়েটের এবারের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ফলাফলে প্রথম হওয়া আদনান আহমেদ তামিম রাজধানীর নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন।

এদিকে ভাইরাল হওয়া পোস্ট থেকে জানা গেছে, প্রথম হওয়া ওই শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য খুবই ফোকাস করে পড়েছেন বলে গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। ভাইরাল হওয়া ওই পোস্টের লেখক দাবি করেছেন, সেই ছাত্রটির এই ফোকাসড পড়াশোনার কাজটা ব্যঙ্গের কারণ, সেই ছেলে পড়াশোনা আর নামাজ পড়ার বাইরে সিনেমা দেখেনি বা খবর পড়েনি বলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছেন লেখক।

মাসউদুল হক নামে একটি আইডি থেকে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট দেয়ার পর সেটি ভাইরাল হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে ওই পোস্টটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ভাইরাল হওয়া সেই পোস্টের একটি স্ক্রিনশট দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে রয়েছে। 

এদিকে, সেই পোস্টটি ফেসবুকে ভাইরাল হলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নেটিজেনরা। তারা বলছেন, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলেটা প্রগতিবাদীদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলেও, সে তার বাবা-মার স্বপ্ন পূরণে পুরোপুরি সফল হয়েছে। সে আসল কাজটাই করেছে।

ভাইরাল হওয়া সেই পোস্টটি

আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থীরা বলছে, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় সফল হওয়া এই ছেলেটিসহ সবাইকে বলবো, তোমাদের যেটা ভালো লাগে, সেটাই করো। জ্ঞানার্জনের অভিযাত্রায় লজ্জার কিছু নেই।

ফেসবুকে সেই পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী লিখেছেন, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলেটা আপনার উজবুক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলেও, সে তার বাবা মার স্বপ্ন পূরণে পুরোপুরি সফল হয়েছে। সে আসল কাজটাই করেছে। আপনি আপনার জেনারেশন দিয়ে আপনার স্বপ্ন পূরণ কইরেন!

আলোচিত লেখক আরিফ আজাদ লিখেছেন, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলেটা যদি শুধু পড়তো, খেতো আর ঘুমোতো, তাহলে কিন্তু খুব ‘ভদ্র’ আর ‘ভালো’ ছেলেটি থাকতো৷ তার প্রেমও করতে হতো না, আর্টও করতে হতো না, ইউক্রেন-রাশিয়া, টেইলর সুইফট কিংবা বিশ্ব অর্থনীতিও বুঝতে হতো না।

তিনি আরও লিখেছেন, ঝামেলা হয়ে গেছে অন্য জায়গায়৷ চব্বিশ ঘণ্টার সময়গুলো সে শুধু খাওয়া, পড়া আর ঘুমে কাটায়নি, সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়েছে। সুতরাং, প্রগতিবাদীদের কাছে এতেই সে ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি’ হয়ে গেছে৷ জি, এখন এটাই রাজনীতি, এটাই প্রগতিবাদ।

বুয়েটের সাবেক ছাত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের অধ্যাপক ড. রগিব হাসান লিখেছেন, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছাত্রটিকে নিয়ে অনলাইনে ট্রোলিং করা একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে দেখতে পেলাম আজ। এই ছেলেটা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্ততির জন্য খুবই ফোকাস করে পড়েছে। লেখকের কাছে সেই ছাত্রটির এই ফোকাসড পড়াশোনার কাজটা ব্যঙ্গের কারণ, সেই ছেলে পড়াশোনা আর নামাজ পড়ার বাইরে সিনেমা দেখেনি বা খবর পড়েনি বলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছেন লেখক! 

প্রথমত, ১৮ বছরের একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক একজন লেখকের এই হিটখোরি লাইকপাপী লেখাটাই খুবই দুঃখজনক। তবে লাইকের মোহে মানুষ কী করতে পারে, তা অনলাইনে থাকায় দেখা হয়েছে, তাই অবাক হইনি। 

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন একটা পরীক্ষা, আর সেটাতে প্রথম হতে হলে কী করতে হয়, সেটা আমি জানি। খুব প্রচণ্ড ফোকাস নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। শুধু বুয়েটের জন্য না, জীবনের যেকোনো কঠিন কাজ করতে গেলে ফোকাস লাগে প্রচণ্ড। সেটা পড়াশোনা হোক, গানবাজনা হোক, খেলা হোক, বা এরকম কিছু। 

ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের বইতে পড়েছি, যেকোনো বিষয়ে দক্ষ হতে হলে লাগে অন্তত ১০ হাজার ঘণ্টার প্রয়াস। বুয়েটের পরীক্ষায় সফল হয়ে শীর্ষে আসতে গেলে এর কাছাকাছিই কষ্ট করা লাগে। যে ছেলেটি এবারের ভর্তি পরীক্ষায় হাজার হাজার ছাত্রকে পিছনে ফেলে প্রথম হয়েছে, তাকে অনেক অভিনন্দন এ কারণেই। 

কিন্তু তার জীবন কেমন হবে, তা ঠিক করে দেয়ার আপনি আমি কে? কেন বলা হবে যে তাকে ১৮ বছর বয়সে সিনেমা দেখতে হবে, কনসার্ট শুনতে হবে? সে যদি দরজা বন্ধ করে পড়ে আনন্দ পায়, তাহলে তাকে নিয়ে জাজমেন্টাল হওয়ার অধিকার কে দিয়েছে? এই ভাইরাল হওয়া পোস্টের লেখক কে যে এই ছেলেটি কী করবে না করবে তার রায় দিয়ে দিবেন তিনি? কেবল বিতর্কের জন্য এই প্রখর মেধাবী ছাত্রটিকে ব্যঙ্গ করে নিজেকে যে আপাদমস্তক পরশ্রীকাতর হিসাবে প্রমাণ করে ফেললেন, সেটা কি বুঝতে পারেন না? 

কেউ সিনেমা দেখে মজা পায়, কেউ কনসার্টে, আবার কেউ ক্যালকুলাসে। আর কারও ক্ষতি না করলে কে কী করছে তাতে পরশ্রীকাতরদের কিছুই বলার নেই। গত বছরেও একই ঘটনা হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে। এটা মনে হয় লাইক কামাবার সহজ একটা উপায়। 

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার আগের ছয় মাস আমিও প্রচণ্ড ফোকাস নিয়ে পড়েছি। বাড়ির বাইরে থেকে কোচিং করে মন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। সিনেমা দেখার সময় পাইনি আমিও, যদিও টিভি দেখেছি অনেক। কিছু ভাল পাওয়ার, অর্জনের জন্য চেষ্টা লাগে, কষ্ট করা লাগে- সারাদিন চিল করে বেড়ালে সেটা পাওয়া যায় না। 

কিন্তু যাই হোক, কেউ যদি পড়াশোনাতেই আনন্দ পায়, তাহলে সমস্যা কই? কোথায় জ্বললে সদ্য কৈশোর পেরুনো এই রকম একটা মেধাবী ছেলেকে গোলামসহ নানা রকমের গালাগাল প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ দিতে পারে, ফেসবুক না থাকলে হয়তো বুঝতাম না। ২৮ বছর আগে ফেসবুকের এরকমের লোকজন ছিলো না বলে মনে হয় বেঁচে গেছি! 

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় সফল হওয়া এই ছেলেটিসহ সবাইকে বলবো, তোমাদের যেটা ভালো লাগে, সেটাই করো। জ্ঞানার্জনের অভিযাত্রায় লজ্জ্বার কিছু নেই। বাঙালির নরকে নাকি দারওয়ান লাগে না। কেন লাগে না, বুঝতেই পারছেন, তাই না? 

ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ-এর শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন লিখেছেন, বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলেটির লাইফ স্টাইল নিয়ে দেশের প্রগতিশীল সমাজ অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ হয়ত ইতিমধ্যে মনের দুঃখে গাঁজার নৌকায় চড়ে পাহাড় দর্শনেও গেছেন! ছেলেটি জীবনে খাওয়া, নামাজ আর ঘুম বাদে বাকি সময় লেখাপড়া করেছে। গান, সিনেমা, গল্প বই, চিল করা বাদ দিয়ে সে তার জীবন নষ্ট করেছে। আবার তার জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্বের বড় টেক কোম্পানিতে জব করা। অর্থাৎ স্বার্থপর প্রবাসী হয়ে অ-দেশপ্রেমিক বনে যাওয়া।


সর্বশেষ সংবাদ