ভিনদেশে লাল-সবুজের পতাকা উড়াতে পারছি, সত্যিই অসাধারণ অনুভূতি
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ১২ জুন ২০১৯, ০৫:৪৩ PM , আপডেট: ১৩ জুন ২০১৯, ০১:২৮ AM
আনিসুল হক রনি, বাংলাদেশি সিরামিক শিল্পী। চীনের নানজিং ইউনিভার্সিটি অব দ্যা আর্টসের (এনইউএ) ডিপার্টমেন্ট অব সিরামিকের মাস্টার্সে পড়ছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মৃৎশিল্প বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। সম্প্রতি আজারবাইজানে দু’সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়াম শেষ করে নানজিং পৌছেন। দীর্ঘ পথের ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে ক্লান্ত আনিসুলের সঙ্গে আড্ডা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। আড্ডার সাতকাহন তুলে ধরছেন ফরহাদ কাদের।
‘ভিনদেশে লাল-সবুজের পতাকা পত পত করে উড়ছে, আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি— সত্যি অসাধারণ অনুভূতি; বাংলদেশের টেরোকাটা শিল্পকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে চেষ্টা করে চলেছি; আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস-সংস্কৃতিকে সমুজ্জল করতে আরও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে অংশ নেয়ার ইচ্ছা। যখনই সুযোগ হয়— সোনার বাংলার লাল-সবুজের পতাকা তুলে ধরতে চাই’— দম না ফেলে কথাগুলো বলে ফেললেন আনিসুল।
পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মাঝে অবস্থিত প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত হলো দু’সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক সিরামিক আর্ট সিম্পোজিয়াম। গত ২০ মে থেকে শুরু হয় ‘ফ্রম ন্যাচার টু হিস্টরি’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামটি। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২২জন সৃজনশীল সিরামিক শিল্পীকে নির্বাচিত করা হয়। আমি বাংলাদেশ থেকে নিমন্ত্রণ পাই।
বিশ্বের প্রাচীন জনগোষ্ঠির মধ্যে অন্যতম আজারবাইজানিয়ান। তাদের দীর্ঘ ইতিহাসে ওতপোতভাবে জড়িত সিরামিক শিল্প। তাই নিজেদের লোক সংস্কৃতিকে সমুন্নত এবং বিশ্ব দরবারে ফুটিয়ে তুলতে এই আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়াম।
সাংহাই থেকে আট ঘন্টার বিমান ভ্রমণে মস্কো শহরে অবতরণ করি। এবার উদ্দেশ্য কাস্পিয়ান সাগরের ওপারে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। তিন ঘন্টার আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হলাম সমুদ্র তীরবর্তী নয়নাভিরাম শহরটিতে। ইতোমধ্যে সিম্পোজয়ামে অংশগ্রহণে বেশ ক’জন শিল্পীও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে চলে এসেছেন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো হোটেল হারমনিতে। অদূরে বিশ্ব অর্থনীতির চাবিকাটি কাস্পিয়ান সাগরের বীচ। প্রথমেই এটি না দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। সবার সাথে নেমে পড়লাম সী বীচে।
পরেরদিন বাকীরাও পৌছে গেছেন। বাকু শহরে বসল নানাদেশের শিল্পীদের মিলন মেলা। দিনের শুরুতে ককেশাশ অঞ্চলের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক শহরটি ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। ছোট শহরটি হোয়াই্ট সিটি নামে বেশ পরিচিত। এটি ইউরোপীয় এবং আধুনিক স্থাপত্যের সংমিশ্রনে গড়ে ওঠেছে। ইউরোপে লোক সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বাকুর নামডাক বেশ ভালো। ঐহিত্যবাহী দালান-স্থাপত্যের অবয়ব দেখলে সহজে তা চোখে ধরা দিবে। বুঝা যাবে কতো আগে থেকে কাস্পিয়ানের কন্যা বাকু আধিপত্য বিস্তার করছে।
এবার চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি পেট ভরানোর বন্দোবস্ত হলো। শহরের প্রাচীন রেস্টুরেন্ট একাতে দুপুরের খাবার। এতোক্ষণ বাকুর যে রূপ উপভোগ করলাম তার অন্য রূপটি খাবারের টেবিলে ধরা পড়লো আরও বহুগুন বৃদ্ধি পেয়ে। স্থানীয় খাবারের বিভিন্ন স্বাদ-রুচি-সুগন্ধ সবই মনে দাগ কাটার মতো। খাবারে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার রসায়ন কাজ করেছে।
বাকুকে বিদায় জানানোর সময় এসে গেল। বিকাল বেলা উত্তর-পশ্চিমের শহর শাকির উদ্দেশ্যে যাত্রা। বাসে পাঁচঘন্টায় পৌছে গেলাম প্রাচীনত্বের ধারক আড়াই হাজার বছরের পুরনো শহরটিতে। এটি আমাদের গন্তব্য। এখানে কাটাতে হবে দু’সপ্তাহ। ছোট ছোট পাহাড়ের মাঝখানে সারি সারি দালান। দূর থেকে দেখলে পাহাড়গুলোকে শহরের প্রাচীর মনে করলে ভুল হবে না।
তেমনি চারদিকে ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা মাক্সল রিসোর্ট। পাঁচ তারকার এই রিসোর্টে বাকী দিনগুলো কাটাতে হবে। ২১ মে শুরু হলো আমাদের সিম্পোজিয়াম। এতোদিনের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা সবই এসে হাজির। এবার টার্গেট দেশের নামটা শাকি শহরে খোদাই করে যাওয়া। ২২ দেশের সব শি্ল্পীদেরও একই বাসনা। পুরোদমে এক সপ্তাহব্যাপী চললো আমাদের মহাযজ্ঞা। অবশেষে যুদ্ধ-নিপীড়িত নারী-শিশুসহ সর্বস্তরে বুলণ্ঠিত মানবতার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার কাজটি শেষ করলাম।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেভা্বে মানবতা লুণ্ঠিত হয়েছিল। অনুরূপ ভাবে ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে আজারবাইজানেও মানবতার উপর নেমে এসেছিলো নির্মম নির্যাতন। সম্প্রতি সিরিয়া ও ইয়ামেনের যুদ্ধপীড়িত দৃশ্য আমাদের বিবেককে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, লুণ্ঠিত মানবতার এই দৃশ্য শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় হাজার বছরের জন্য রাজসাক্ষী হয়ে থাকবে। মানুষ বুঝতে পারবে এই গ্রহে কখন কীভাবে মানবতার উপর আঘাত এসেছে। পাশাপাশি মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলতেও যথেষ্ট পরিমাণে ভূমিকা পালন করবে এই আর্ট শিল্প।
এবার কাজের ফাঁকে ঘুরে আসলাম শাকির ঐতিহাসিক স্থপত্যগুলো। এই শহরে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন রাজশক্তির ব্যাপক উপস্থিতির চাপ এখনো চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন সময় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো শাকির উপর রাজত্ব করেছে। সে সুবাদে এখানে মুসলিম-খ্রিস্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস। রয়েছে মসজিদ, চার্চ সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে খান প্যালেস, ওমর মস্ক, গিলাহি মস্ক, চার্চ অব কিশ ও কাভান্সারি ঘুরে দেখলাম।
সিম্পোজিয়ামে বানোনো সিরামিকের ভাস্কর্যগুলো সপ্তাহব্যাপী শাকির আউট-ডোরে প্রদর্শিত হলো। অবশেসে ঘনিয়ে আসল আজারবাইজানে বিদায়ের ঘন্টা। এরইমধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিল্পীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে ওঠলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলছিলো চায়ের আড্ডা, এক সঙ্গে নাচ। আর পেশাগত কাজের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করতাম আমরা। পাশাপাশি নিজেদের দেশের কালচার-গান-ভাষা নিয়ে সমানে চলতো আনন্দ-উল্লাস। অতপর ২ জুন শেষ হলো সিম্পোজিয়ামটি।
ইতোমধ্যে আমি তিনটি আন্তর্জাতিক আর্ট সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছি। মনে করি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য শিল্পীর অনেক কিছু করার আছে। তাই জাত, বংশ, ধর্ম এবং দেশের সীমানা চিন্তা না করে সবার উচিত শান্তি, সাম্য, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার এবং ভালো ভবিষ্যত গড়ার পক্ষে আওয়াজ তোলা।