সংস্কার চায় সব ছাত্র সংগঠন, ডাকসু নির্বাচনের সময় নিয়ে বিরোধ
- শিহাব উদ্দিন
- প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫০ PM , আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২৫ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো সংস্কার ইস্যুতেও একমত। তবে দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সংগঠনগুলো। সবাই সংস্কার চাইলেও ডাকসু নির্বাচনের সময় নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শিবির এবং বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী বলছে, নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হওয়া জরুরি। তবে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্টসহ অন্তত চারটি ছাত্র সংগঠনের মত, সিন্ডিকেট থেকে আওয়ামীপন্থিদের সরিয়ে এবং গঠনতন্ত্র সংশোধনের পর নির্বাচন দিতে হবে।
২০১৯ সালে সবশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এরপর ৫ বছরে আর কোনও নির্বাচন হয়নি। এ অবস্থায় দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে চারটি ছাত্র সংগঠন। এ সময় তারা প্রশাসনকে আল্টিমেটামও দেয়। পরেরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভা চলাকালীন যৌক্তিক সংস্কারের পর নির্বাচন দেওয়ার দাবি তোলেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তখন দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন।
২০১৯ সালে সবশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এরপর ৫ বছরে আর কোনও নির্বাচন হয়নি। এ অবস্থায় দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে চারটি ছাত্র সংগঠন।
সংস্কারের পর নির্বাচনের দাবি তোলা ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, সব ছাত্র সংগঠনই চায় ডাকসু নির্বাচন হোক। তবে নির্বাচনের আগে গঠনতন্ত্র সংশোধনসহ ক্যাম্পাসে রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য প্রশাসনকে যৌক্তিক সময় দিতে চান তারা।
অন্যদিকে ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর দাবি, নির্বাচনের রোডম্যাপের মধ্যেই গঠনতন্ত্র সংশোধন এবং সিন্ডিকেট থেকে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অপসারণের বিষয়টি রাখা যায়। নির্বাচনের পর ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে সব বিষয়েই সংস্কার করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ছাত্রদল অবশ্যই ডাকসু নির্বাচন চায়। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় করতে ডাকসু নির্বাচন দরকার। তবে ২০১৯ সালে ডাকসুর যে গঠনতন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল, সেটি ছাত্রলীগকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। এটি সম্পূর্ণ সংশোধন করতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি বাস্তবায়ন না হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।’
‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় করতে ডাকসু নির্বাচন দরকার। তবে ২০১৯ সালে ডাকসুর যে গঠনতন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল, সেটি ছাত্রলীগকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। এটি সম্পূর্ণ সংশোধন করতে হবে।’-নাহিদুজ্জামান শিপন, সভাপতি, ঢাবি ছাত্রদল
ফেব্রুয়ারির মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যে সংগঠনগুলো দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে না, তারা চ্যালেঞ্জ নিয়েই আগের ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে তারা এখন কেন এই চ্যালেঞ্জগুলো নিতে চাচ্ছে না, সেটি আমার বোধগম্য নয়।’
মৌলিক সংস্কার তারাও চান জানিয়ে এস এম ফরহাদ বলেন, ‘সংস্কারগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই করা সম্ভব। এজন্য খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। নির্বাচনের সময়সীমার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যে সময় বেধে দেওয়া হয়েছে, সে সময়সীমার মধ্যেই আমরা ডাকসু নির্বাচন চাই।’
‘যে সংগঠনগুলো দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে না, তারা চ্যালেঞ্জ নিয়েই আগের ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে তারা এখন কেন এই চ্যালেঞ্জগুলো নিতে চাচ্ছে না, সেটি আমার বোধগম্য নয়।’ সভাপতি, ঢাবি শাখা ছাত্রশিবির
দ্রুত ডাকসু নির্বাচন না হলে ক্যাম্পাসে নতুন ধারার ছাত্র রাজনীতি চালু করা সম্ভব নয় জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতিমা বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন হওয়া দরকার। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অবশ্যই সংশোধন করা দরকার। তবে এজন্য কালক্ষেপণ করা যাবে না।’
দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ চান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ডাকসু না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো সঠিক জায়গা পর্যন্ত পৌঁছায় না। ডাকসু শিক্ষার্থীদের জন্যই। সংস্কারের নামে নির্বাচনের সময় বিলম্ব করা যাবে না। এজন্য দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। কোন সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে, সেটি জানা থাকলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সবাই সমান সুযোগ পাবেন।’
ডাকসুর গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা জটিল কোনো বিষয় না উল্লেখ করে শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, ‘ডাকসুর জন্য যে রোডম্যাপ তৈরি করা হবে, সেখানে গঠনতন্ত্র পরিবর্তনসহ সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরা সম্ভব। কোন সময় কোনটি করা হবে, অর্থাৎ নির্বাচন কবে হবে, যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের কি হবে, সিন্ডিকেট থেকে আওয়ামীপন্থিদের কীভাবে সরানো হবে- এ বিষয়গুলো রোডম্যাপের মধ্যে উল্লেখ থাকলে সব সংগঠনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে।’
তিনি বলেন, আমরা পুরো প্রক্রিয়ায় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে চাই। তবে ক্যাম্পাসের যে সার্বিক পরিস্থিতি, সেটি কবে স্বাভাবিক করতে পারবে- সে বিষয়ে প্রশাসন কিছু বলছে না। প্রশাসনকে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। অন্যথায় ডাকসু নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।’
এখন ক্যাম্পাসে ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ নেই উল্লেখ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সোহাইল আহমেদ শুভ বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ওপর দায় চাপিয়ে ক্যাম্পাসে সেই অর্থে রাজনীতি করতে দেওয়া হচ্ছে না। বিশেষ করে হলগুলোতে।’
তার ভাষ্য, ‘আমরা যদি শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরতে না পারি, তাহলে নির্বাচন করব কীভাবে? হলগুলোতে আগে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রচার-প্রচারণার পরিবেশ আনতে হবে। সংস্কারের প্রয়োজন আছে, তবে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা বেশি জরুরি।’
বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি নাজিয়া হাসান রাশা বলেন, ‘আমরা অতিদ্রুত ডাকসু নির্বাচন চাই। জানুয়ারির মধ্যে অবশ্যই ডাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে, আমরা এমন ঘোষণা শুনতে চাই। তবে বর্তমান যে গঠনতন্ত্র রয়েছে, সেখানে ফ্যাসিবাদী উপাদান এবং অগণতান্ত্রিক বিষয় রয়েছে। সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে।’
আরো পড়ুন: ঢাবির অধীনে হচ্ছে সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা
ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তারা প্রস্তাব দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সে প্রস্তাবনা নিয়ে প্রশাসন এখনো কিছু বলেনি। ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য হলগুলোর দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতে হবে। তাহলেই সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীরা কোনো কালক্ষেপণ দেখতে চায় না।’
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আমরা উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সব ছাত্র সংগঠন একসঙ্গে ছিল। তবে এখন সবাই নিজেদের দল নিয়ে ব্যস্ত। এখন শিক্ষার্থীদের কথা বলার জন্য ডাকসু নির্বাচন দরকার।’
নির্বাচন আয়োজন করতে প্রশাসনকে সময় দেওয়া যায় মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা জরুরি। ঘোষণাপত্রে সংস্কারের বিষয়গুলো উল্লেখ থাকলেই ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে যে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, সেটি দূর হবে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি শাখার সভাপতি মোহাম্মদ সানাউল্লাহ হক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি মনে করে, এই মুহূর্তে ডাকসু নির্বাচন করা সম্ভব- তাহলে তারা নির্বাচন দেবে। আমাদের তাতে সমর্থন থাকবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মতামতকেও প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যখন চাইবে, তখনই নির্বাচন দিতে হবে। যে বিষয়ে সংস্কার করা প্রয়োজন, সেটি শিক্ষার্থীরাই প্রস্তাব আকারে জমা দেবে।’