হলে হলে বৈষম্যবিরোধী গ্রুপ, উদ্দেশ্য— ‘ছাত্র রাজনীতি নিধন’

হলে হলে বৈষম্যবিরোধী গ্রুপ, উদ্দেশ্য— ‘ছাত্র রাজনীতি নিধন’
হলে হলে বৈষম্যবিরোধী গ্রুপ, উদ্দেশ্য— ‘ছাত্র রাজনীতি নিধন’  © সম্পাদিত

শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা যে ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে, তার মধ্যে ৭ নম্বর দাবিটি ছিল দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে হবে। এই দাবিটিকেই যেন মনে-প্রাণে গেঁথে নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বৈধ শিক্ষার্থীরা। 

ক্যাম্পাসে ছাত্রদল বা ছাত্র শিবিরের দখলদারিত্বের শঙ্কা এবং তা প্রতিরোধের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিটি হলের নামের সাথে ছাত্র সংসদ যোগ করে মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব গ্রুপে হলগুলোয় কীভাবে দলীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক ফায়দা লুট করার পাঁয়তারা বন্ধ করা যায়— তা নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

কী হচ্ছে মেসেঞ্জার গ্রুপে? এমন প্রশ্নের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকার পতনের পর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সব শিক্ষার্থীরা বেশ আত্মবিশ্বাসী। তারা মনে করছেন, বর্তমানে নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেরাই যথেষ্টা। এজন্যই তাদের এই গ্রুপ। হলের ক্যান্টিন, রিডিং রুম ও সিট বন্টনসহ যেকোনো সমস্যা তৈরি হলে নিজেরাই তা মেসেঞ্জার গ্রুপে দিচ্ছেন এবং সেখান থেকেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রয়োজনে গ্রুপভিত্তিক জড়ো হয়েও শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন-দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। 

আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে গতমাসের ১৭ তারিখ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে হল ছাড়া করেন আন্দোলনরত ছাত্ররা। চলতি মাসের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচরণ বন্ধ হলেও বিএনপিপন্থি ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, জামায়াতপন্থী ছাত্র শিবির ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো হল দখলের চেষ্টা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হলের আশেপাশে ছাত্রদলের শোডাউনের ফলে এমন আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী। 

৫০ বছরের ইতিহাসে দলীয় দখলদারিত্বমূলক ছাত্র রাজনীতি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। তারা দলের সেবার কাজে সাধারণ ছাত্রদেরকে বারবার ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সহাবস্থান কখনও ছিল না; তা যে ছাত্র সংগঠনের হাতেই ক্ষমতা থাকুক না কেন। —সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বাতিল চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন মোসাদ্দেক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা দেশের ৫০ বছরের ইতিহাস দেখেছি যে দলীয় দখলদারিত্বমূলক ছাত্র রাজনীতি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। তারা দলের সেবার কাজে সাধারণ ছাত্রদেরকে বার বার ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সহাবস্থান কখনও ছিল না; তা যে ছাত্র সংগঠনের হাতেই ক্ষমতা থাকুক না কেন। এটা আমরা আর চাই না। এসব কারণেই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি— হলে হলে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। তার বক্তব্য, এমন ছাত্র রাজনীতি আমরা চাই না; যা শিক্ষার্থীদের ভালোর পরিবর্তে নির্যাতনের শিকারে পরিণত করে।

quota ছাত্র-জনতার গণমিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

মোসাদ্দেক বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে। এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীবান্ধব লেজুড়বৃত্তিহীন ছাত্র সংসদ গঠন করে শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতি চালানো হবে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় রাজনৈতিক মনোভাব থাকলেও বা নিজ নিজ আদর্শ থেকে রাজনীতি করলেও শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম আর পরিচালিত করতে দেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে কথা হয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের একাংশের সভাপতি সালমান সিদ্দিকীর সঙ্গে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, রাজনীতি শিক্ষার্থী মৌলিক অধিকার। ছাত্র রাজনীতি থাকা উচিৎ। তবে হলে হলে যে দখলদারিত্বের ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে দলীয় স্বার্থ কায়েম করার যে ছাত্র রাজনীতি; আমরা সেটা চাই না। সকলের রাজনৈতিক মনোভাব থাকবে এবং তারা তাদের আদর্শ অনুযায়ী রাজনীতি করবে তবে কোনো ধরনের জোরপূর্বক দখলদারিত্বের রাজনীতি আমরা চাই না। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকেই এই দখলদারিত্বের রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হবে এবং দ্রুত ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে।

আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ নিষ্পেষিত। আর পরাধীন থাকতে চাই না। হলে হলে দখলদারিত্বের রাজনীতি দেখতে চাই না বলেই ছাত্রলীগকে বের করে দিয়েছি; যদিও সময় লেগেছে ১৫ বছর। সেই সুযোগ আমরা আর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে দেব না। আমরা নিজেরাই আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করব।— শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এদিকে হলে হলে ছাত্রদল, বহিরাগত বা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে হল দখল করতে চাওয়া যেকোনো গ্রুপকে প্রতিহত করতে হলে হলে ছাত্র সংসদ মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে একত্রিত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হলের অভ্যন্তরে যেকোনো রাজনৈতিক দলের দখলদারিত্বমূলক মনোভাব রুখে দিতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।

এমনই একজন কবি জসীমউদ্দীন হলের এক শিক্ষার্থী জানান, আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ নিষ্পেষিত। আমরা আর পরাধীন থাকতে চাই না। হলে হলে দখলদারি রাজনীতি আমরা দেখতে চাই না বলেই ছাত্রলীগকে বের করে দিয়েছি; যদিও আমাদের সময় লেগেছে ১৫ বছর। সেই সুযোগ আমরা আর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে দিতে চাই না। আমরা নিজেরাই আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করব। 

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমাদের দাবি দলমত নির্বিশেষে সকলে থাকতে পারবেন তবে তাদেরকে আবাসিক বৈধ শিক্ষার্থী হতে হবে। প্রশাসন সিট নিয়ন্ত্রণ করবে। এখানে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। সবাই দলমত নির্বিশেষে সাধারণ শিক্ষার্থী হয়ে থাকতে হবে। তবে যারা এতদিন হলে ছিলেন গণরুমে বা ফ্লোরিং করে তারা এখন হলে উটজার ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাবে। তারা হলে উঠার পর সিট খালি থাকলে অন্যরা আসবে। মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকেও খুব দ্রুত হল ত্যাগ করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের এমন সিদ্ধান্তের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে হলের অন্যান্য আবাসিক শিক্ষকরাও। তারা সর্বক্ষণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন একাধিক শিক্ষক।


সর্বশেষ সংবাদ