গণরুমের শোচনীয় বর্ণনা ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের প্রশ্নে

ঢাবির একটি হলের গণরুম
ঢাবির একটি হলের গণরুম  © সংগৃহীত

একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলের গণরুমে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব শিক্ষার্থীদের জেলখানায় কারাবন্দি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা না থাকলেও রয়েছে তার চেয়েও ভয়াবহ গণরুমে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি বিভাগের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এ গণরুমের শোচনীয় অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে। নেটিজেনরা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে গতানুগতিক প্রশ্ন করলেও অনেক শিক্ষক এখনো বাস্তবভিত্তিক প্রশ্ন প্রণয়ন করছে। 

এর আগে গত সোমবার (৩ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়টির সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বেনজীরের দুর্নীতি ও আনারের হানিট্র্যাপ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসা পেয়েছে। 

জানা যায়, আজ বুধবার (৫ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের মার্কেটিং বিভাগের এমবিএ  প্রথম সেমিস্টারের ৫১৩ নম্বর কোর্সের (নন প্রফিট-সোশ্যাল মার্কেটিং) ফাইনাল পরীক্ষায় গণরুম শোচনীয় অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। 

প্রশ্নপত্রের উদ্দীপকে লেখা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুতর মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়। কেউ কেউ উদ্বেগ এবং হতাশার শিকার হন আবার কেউ কেউ গুরুতর মানসিক ব্যাধিতে ভোগেন। এর পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। কারণগুলোর মধ্যে আবাসনের অভাব, র‌্যাগিং, নতুন পরিবেশের সাথে  নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারাসহ আরো অনেক কিছু।  

উদ্দীপকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষার্থীদের প্রায়শই গণরুমে বাস করতে হয় যেখানে একসাথে ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী বসবাস করে। সেসব গণরুমে প্রয়োজনীয় বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্যবিধি নেই এছাড়াও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু নেই। 

গণরুমের বিষয়ে আরো বলা হয়, গণরুমগুলো রাজনৈতিক দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সেখানে ছাত্রদের বাকস্বাধীনতা নেই। এছাড়াও দুর্বৃত্তায়ন চক্র তৈরি করে তাদেরকে ভয় এবং আতঙ্কের মাঝে রাখে এবং র‌্যাগিং অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয় এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।  

marketing 

উদ্দীপকে আরো বলা হয়, এদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তারা ভর্তি হয় নিজের স্বপ্ন পূরণে পরিবারের, সমাজের এবং বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ভয় ও আতঙ্কের মাধ্যমে যে মানসিক চাপ তৈরি করা হচ্ছে এ জন্য দেশকে মারাত্বক পরিণতি ভোগ করতে হবে।   

এসময় প্রশ্ন করা হয় অলাভজনক সংস্থার ব্যবস্থাপক হিসেবে এ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা এবং এ ধরনের আচরণ পরিবর্তন করার জন্য কি ধরনের কৌশল প্রণয়ন করবে জানতে চাওয়া হয়।

এদিকে, এ প্রশ্নপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক কেন্দ্রীক বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করা হচ্ছে। প্রশ্নপ্রণয়নে জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশংসা করছে।  

জানতে চাইলে মার্কেটিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের কোর্সের নাম নন প্রোফিট এন্ড সোশাল মার্কেটিং। কোর্সের টপিকের সাথে সাদৃশ্য রেখেই প্রশ্নটা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন, শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা, হলের পরিবেশে টিকে টাকার সমস্যা, বাসস্থানের সমস্যা। এগুলো থেকে কিভাবে তাদেরকে  অলাভজনকভাবে মোটিভেট করে তোলা যায়, এই বিষয়টি এই কোর্সের প্রশ্নে তুলে ধরা হয়েছে।

জানতে চাইলে প্রশ্ন প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরীন আক্তার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা কোনো হল বা নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নয়। এটা একটা জাস্ট কোশ্চেন যেখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে।  

আরও পড়ুন: ঢাবির প্রশ্নপত্রে বেনজীরের দুর্নীতি ও আনারের হানিট্র্যাপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম

দেশের কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম জায়গা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৬ ফুট করে। আর স্কয়ার ফিট (বর্গফুট) হিসেবে সেটি দাঁড়ায় ৩৬-এ। কিন্তু ঢাবির আবাসিক হলের গণরুমের থাকার জন্য একজন শিক্ষার্থী গড়ে ১৬ থেকে ১৭ স্কয়ার ফিট থাকার জায়গা পান। ফলে কারাগারে থাকা একজন কয়েদির অর্ধেক জায়গাও পান না গণরুমের শিক্ষার্থীরা। 

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে ১২৮টি গণরুমের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান বলছে, ঢাবির মোট ১৯টি হলের মধ্যে ১৮টি হল নিয়ন্ত্রণ করে সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর বাহিরে বাকি একটি ইন্টারন্যাশনাল হলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে প্রশাসনের অধীনে। এই ১৮টি হলের ১২৮টি গণরুমে থাকেন প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী। এদের অধিকাংশই প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের। বিভিন্ন আয়তনের ছোট-বড় গণরুমে বসবাস করেন গড়ে ২০ দশমিক ৮৫ জন করে। 

এর মধ্যে ছেলেদের ১৩টি হলে ৮৫টি গণরুমে বর্তমানে ১ হাজার ৮০০-এর অধিক শিক্ষার্থী থাকেন। আর মেয়েদের ৫টি হলে ৪৩টি গণরুমে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী থাকেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসেন, সেই স্বপ্ন বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় গণরুমেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সময় বিষয় জেনেও তারা এ সংস্কৃতি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না। কারণ গণরুমের সঙ্গে রাজনীতির একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ