অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ফেনীর জাম্বারা দিঘি

অতিথি পাখি
অতিথি পাখি  © টিডিসি ফটো

ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে পাখি, কিছু পাখি দলবেঁধে উড়ছে কেউ আবার মাথা নুইয়ে গোসল করছে। চারদিকে কিচিরমিচির শব্দ, এ যেন চোখ জুড়ানো অপরূপ দৃশ্য। প্রতি বছরের মতো এ বছরও ঝাঁকে ঝাঁকে আসা এসব অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের মধ্যম জাহানপুর গ্রামের জাম্বারা দিঘি। 

হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বরফ শীতল দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা এসব পাখির কলকাকলিতে পুরো গ্রাম এখন মুখরিত। গ্রামবাসীও পরম যত্নে আগলে রাখছেন অতিথিদের। পাখিপ্রেমীরা এ দৃশ্য একনজর দেখার জন্য ছুটে আসছেন দূরদূরান্ত থেকে। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দিঘির পাড়ে এক অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য। পাখিদের দিনভর জলকেলি, খুনশুটি আর কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত চারদিকের পরিবেশ। কখনো ঝাঁক বেঁধে নান্দনিক কসরতে ডানা মেলে নীল আকাশে উড়ে বেড়ায় তারা।

দিঘির এক প্রান্তে গ্রামের বাসিন্দারা গোসলসহ দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত, আর অপর প্রান্তে পাখিরা গড়ে তুলেছে তাদের নিরিবিলি রাজ্য। প্রতিদিন শত শত মানুষ এ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে ভিড় করলেও অতিথি পাখিদের জীবনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। বরং গ্রামের মানুষ অতিথিদের পরম যত্নে রক্ষা করছেন শিকারিদের হাত থেকে। এ সহাবস্থান প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনের এক সুন্দর উদাহরণ বলে জানান দর্শনার্থীরা।

জানা গেছে, পানকৌড়ি, বালি হাঁস, রাঙ্গা ময়ূরী, ছোট স্বরালী পরিযায়ী পাখির এ বিচরণ ক্ষেত্রটি ডিসেম্বরের শেষের দিক থেকেই শুরু হয়। শীতপ্রধান এলাকা থেকে আসা এসব অতিথি পাখি অনুকূল পরিবেশ আর প্রয়োজনীয় খাবার নিশ্চিত হওয়ায় আস্তানা গড়ে এ দিঘিতে। পাখি প্রেমীরা বলছেন, এ দিঘিতে প্রায় ১০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে এবার। ডিসেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিঘিটিতে অবস্থান করে এই পাখি।

 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ছোটবেলা থেকে তারা এ দিঘিতে অতিথি পাখিদের আগমন দেখতে অভ্যস্ত। প্রতি বছরের শীতের সময়, যখন ঠান্ডা হাওয়া শুরু হয়, তখন এই দিঘিতে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে। এটি যেন একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, এই অতিথি পাখিরা তাদের দূরদূরান্ত থেকে চলে আসেন এবং শীতকালটি এখানে কাটিয়ে আবার চলে যান, যা প্রাকৃতিকভাবে এলাকার পরিবেশে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।

এই অতিথি পাখিদের উপস্থিতি শুধু স্থানীয়দের জন্যই আনন্দের নয়, বরং দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরাও পাখিদের দেখতে এখানে আসেন। তাদের কিচিরমিচির শব্দ, উড়ন্ত পাখির ঝাঁক, আর পাখিদের বিচরণ দেখে দর্শনার্থীরা অভিভূত হন। এ দৃশ্যকে তারা একটি জীবন্ত উপাখ্যান হিসেবে মনে করেন, যা প্রকৃতির অদ্ভুত এবং চমকপ্রদ সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সোবহান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শীতকালে জাম্বারা দিঘিতে এসব পাখি আসতে শুরু করে যা আমরা ছোট থেকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। প্রতি বছর এই সময় তারা এখানে অবস্থান করে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায়। তাদের উপস্থিতি আমাদের গ্রামকে এক অন্যরকম সৌন্দর্য প্রদান করে, যা এখানে বসবাসরতদের জন্য আনন্দদায়ক এক দৃশ্য। এই পাখির দল দেখতে প্রতিদিন স্থানীয়রা ও পাখিপ্রেমীরা দিঘির আশপাশে ভিড় করে, যেন প্রকৃতির এই অপূর্ব দানটিকে আরও কাছে থেকে উপভোগ করতে পারে।

গ্রামের আরেক বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, শীতকাল আসতেই অতিথি পাখিরা আসা শুরু করে। আমরও তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিই। দিঘির এক পাশে গ্রামের মানুষরা গোসলসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম করে, আর অন্যপ্রান্তে পাখিরা তাদের নিজের মত করে দিনযাপন করে।

মধ্যম জাহানপুর গ্রামের আল মামুন নামের এক যুবক বলেন, পাখিদের নিরাপত্তা সম্পর্কে গ্রামের যুবকেরা সহ সবাই সজাগ থাকে। দর্শনার্থীদেরকে পাখিদের বিরক্ত না করতে সচেতন করা হয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হওয়াতে এ দিঘিতে আগত পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পাখিপ্রেমীরা। পাখিদের সৌন্দর্য অসাধারণ অনুভূতি বলে উল্লেখ করেন দর্শনার্থী জয়নাল আবেদীন, তিনি বলেন দিঘিটির বিষয়ে আগে জানতাম না। এখানে পাখিগুলো দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগে। এখানকার স্থানীয়রাও পাখিদের যত্ন নেয়৷ খাবার দেয়, কেউ বিরক্ত করে না তাদের৷ এমন দৃশ্য সচরাচর এখন দেখা মেলে না। তাই দূর থেকে ছুটে এলাম পাখিগুলো দেখার জন্য।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জসিম উদ্দিন তার এলাকায় পাখিদের আগমনে আনন্দিত। তিনি অতিথি পাখিদের স্বাগত জানাতে দিঘিতে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন এবং দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট পাখি দেখার স্থান তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, মধ্যম জাহানপুরের জাম্বারা দিঘিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি পাখি আসে। পাখি শিকার বা বিরক্ত করার আশঙ্কা এড়াতে এলাকাবাসী সবসময় সতর্ক থাকে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে বিলবোর্ড ও ফেস্টুন স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয়দের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যারা পাখিদের খাবার এবং পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করে। বাইরের দর্শনার্থীদের জন্য পাখি দেখার জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং জেলা প্রশাসন থেকেও খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফেনীর এই ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।

ফেনী শহর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমে অবস্থিত শর্শদি ইউনিয়নের মধ্যম জাহানপুর গ্রামের জাম্বারা দিঘি। এ দিঘি শহর থেকে সড়কপথে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে। শহরের ট্রাংক রোডের মদিনা বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি অটোরিকশায় সরাসরি জাম্বারা দিঘি পৌঁছানো যায়। জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ২০ টাকা, তবে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে আসা-যাওয়ার খরচ পড়ে ২০০ টাকা। এছাড়াও ফেনী মহিপাল থেকে ফতেহপুর ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে সহজেই জাম্বারা দিঘিতে যাওয়া সম্ভব।


সর্বশেষ সংবাদ