প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে প্রথম বিসিএসে তৃতীয় নুরুল হামিদ

টিডিসি সম্পাদিত
টিডিসি সম্পাদিত

অধ্যবসায় ও পরিশ্রমই মানুষকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কক্সবাজার সদর উপজেলার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল ফয়েজ ও নুর জাহান দম্পতির সন্তান নুরুল হামিদ। ছোট থেকেই নুরুল হামিদ ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। কৃতিত্বের সঙ্গে বৃত্তিসহ প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক শেষ করে ৪.৮৮ জিপিএ নিয়ে ২০০৫ সালে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। মাধ্যমিক শেষের পর চোখেমুখে বড় হওয়ার অদম্য স্বপ্ন ও নেশা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পাড়ি জমান তিনি। ভর্তি হন চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজে।

চট্টগ্রাম শহরে আর্থিক টানাপোড়নে চলা বড় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় তার পক্ষে। মেস ভাড়া, খাবারের খরচ, পত্রিকা বিল, টিউশন খরচ, কলেজে যাতায়াত খরচ ইত্যাদি সব খরচ মিটিয়ে অজানা এ শহরে থাকতে বেশ হিমশিম খেতে হয় নুরুল হামিদের। দুর্ভাগ্যবশত ওই সময় তিনি কোনো টিউশনও জোগাড় করতে পারেননি। পরিবার থেকে যে অর্থের জোগান আসত, তা দিয়ে চলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য, যা তার শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে নুরুল হামিদ বিষয়টি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল আলীমকে বললে তিনি কলেজ পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় কলেজ পরিবর্তন (টিসি নিয়ে) করে ২০০৬ সালের এপ্রিলে নিজের শহরের কক্সবাজার সরকারি কলেজে ফেরত আসেন। পরে ২০০৭ সালে সাফল্যের সঙ্গে জিপিএ ৫.০০ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার এ সাফল্যমণ্ডিত ফলের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জানান কক্সবাজার সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক সুনীল চন্দ্র পাল, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক মফিদুল আলম, রসায়নের শিক্ষক অহিদুল ইসলাম ও গণিতের শিক্ষক আজিজসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে।

আরও পড়ুন: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ চলতি সপ্তাহে

উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আবারও স্বপ্নচূড়ায় পৌঁছানোর নেশায় মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন, তবে নানা ধরনের কাজের চাপে তার সেই স্বপ্ন মাটিচাপা পড়ে যায়। ভর্তি হন ফুল স্কলারশিপে পিএইচপি পরিচালিত ইউআইটিস ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইন্জিনিয়ারিংয়ে। তবে ইন্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। নাড়ির টানে দুই সেমিস্টার শেষ হতে না হতেই কক্সবাজারে ফিরে আসেন তিনি।

এরপর জীবিকার তাগিদে পড়াশোনা ছেড়ে একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি শুরু করেন সামান্য বেতনে। পারিবারিক টানাপোড়ন, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা এসব দেখে আরও একটু ভালো থাকার আশায় স্থানীয় ‘কোস্ট ট্রাস্ট’ নামের একটি এনজিওতে চাকরি শুরু করেন। এভাবেই একটি বছর অতিবাহিত হয়।

পরবর্তী সময়ে এক বন্ধুর (আজিমের) পরামর্শে তারই কেনা ফরমে চাকরিরত অবস্থায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কক্সবাজার সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকে ভর্তি হন তিনি। চাকরিরত অবস্থায় অনার্সের দুটি বর্ষ শেষ করেন। ফলও তুলনামূলক ভালো হতে থাকে। পরে নুরুর হামিদের প্রাথমিকের শিক্ষক খুরশেদের পরামর্শে আরও ভালো ফলের আশায় চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর্থিক বিকল্প হিসেবে শহরের আশপাশে কয়েকটি টিউশনি শুরু করেন নুরুল হামিদ। তার পড়ানো, শিক্ষার্থীদের ফল সব মিলিয়ে শিক্ষক হিসেবেও নুরুল হামিদের সুনাম ছড়াতে থাকে চারদিকে। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি, সাফল্য নিজে এসে ধরা দিয়েছে তাকে।

আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষার মান না বাড়ায় আমরা উদ্বিগ্ন: গণশিক্ষা উপদেষ্টা

অনার্সের সম্মিলিত ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় পর্যায়ে মেধাতালিকায় অষ্টম হন। পরে প্রথমবারেই ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে তৃতীয় হন তিনি। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল তার নিজের কলেজ, নিজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ। যে শিক্ষকরা নুরুল হামিদকে পাঠদান করেছেন, তারাই হন সহকর্মীকে।

নুরুল হামিদ বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পিএইচডি গবেষক হিসেবে গবেষণা করছেন পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। 

আরও পড়ুন: শেষ হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা

নুরুল হামিদ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রেজাউল করিম মোহাম্মদ তারেক বলেন, ‘নুরুল হামিদ ব্যক্তি হিসেবে অনেক সৎ, চৌকস ও কর্মঠ একজন মানুষ। তার মেধা, তার গবেষণা তাকে দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করে তুলবে বলে আশা করি।’

নুরুল হামিদ তার বাবা-মা, নিকট আত্মীয়, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধবসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং দেশ ও দশের কল্যাণে তার জ্ঞান ও মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেন।


সর্বশেষ সংবাদ