নেতা আসে নেতা যায়— খবরের শিরোনাম পাল্টায় না ছাত্রলীগের

  © ফাইল ছবি

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নির্যাতনে ২০১৯ সালে মারা যান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। এই ঘটনায় দেশসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এ সংগঠনটির ব্যাপক সমালোচনা হয়। শুধুমাত্র আবরার হত্যাকাণ্ড নন, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহণের পরে এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ দলীয় নেতা দিয়াজ ইরফান, পুরান ঢাকার দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাসসহ প্রাণ হারিয়েছেনে একাধিক শিক্ষার্থী, নিজ দলীয় কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষ। আর এসব ঘটনায় নির্যাতিত ও আহতের সংখ্যা অগণিত। 

প্রতিটি ঘটনার পরেই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা ঘোষণা দেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তারা। বিভিন্ন সময় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা থামাতে পারেনি ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকান্ড। বারবার খারাপ খবরের শিরোনাম এই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

আরও পড়ুন: আবরার হত্যাকান্ড: ছাত্রলীগ থেকে ১১ জনকে স্থায়ী বহিষ্কার

বিগত ১২ বছরে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বে ৫ বার পরিবর্তন এলেও কেউই লাগাম টানতে পারেননি নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাকে। এ নিয়ে একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যদি ভালো খবরের শিরোনাম হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মা শান্তি পাবে।” এসময় তিনি ছাত্রলীগকে খারাপ খবরের শিরোনাম না হতে বলতেন। 

সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেয়া হয় সাদ্দাম হেসেন এবং শেখ ইনানকে। অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন ইমেজধারী এই দুই ছাত্রনেতা সংগঠনটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল সকলের। দায়িত্ব গ্রহণের পর সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করতে দেখা গেছে তাদের। তবে এসব পদক্ষেপকে তোয়াক্কা করছেন না স্বয়ং সংগঠনটির নেতাকর্মীরাই। 

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে কাজ করবে: শিক্ষামন্ত্রী

বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব গ্রহণের পর বিগত দেড় মাসেই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের দ্বারা শিক্ষার্থী নির্যাতন-চাঁদাবাজিসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক বিতর্কিত কর্মকান্ড হয়েছে। এসব কর্মকান্ডের জেরে নির্যাতিত হয়েছেন প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী এবং আন্ত:কোন্দলের জেরে আহত হয়েছেন অর্ধ শতাধিক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী শুধু গত সপ্তাহে ছাত্রলীগের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন অন্তত ১২ জন সাধারণ শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন: চাঁদা না পেয়ে টিকিট কাউন্টারে তালা দিলেন ছাত্রলীগ নেতা

নির্যাতিতদের মধ্যে মেডিকেল পড়ুয়া ৪ জন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি শিবির সন্দেহে চার শিক্ষার্থীকে রাতভর মারধর করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নির্যাতনের জেরে দুই শিক্ষার্থীকে চমেকের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। একইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে বহিরাগত এক ব্যক্তিকে ডেভিলস ব্রেথ বা স্কোপোলামিন (চেতনানাশক) ব্যবহার করে কিডন্যাপের অভিযোগ ওঠে। এ সময় ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং আরো ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পাশাপাশি, তাকে বেধরক মারধরও করা হয়। 

আরও পড়ুন: চমেকের ৪ ছাত্রকে রাতভর পেটালেন ছাত্রলীগ কর্মীরা

৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসময় তারা শিক্ষার্থীদের ব্যানার ফেস্টুন কেড়ে নেয় এবং সাংবাদিকরা ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে চাইলে নারী সাংবাদিকসহ কর্তব্যরত সাংবাদিকদের হেনস্তা করে। এ ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থী-সাংবাদিকসহ ৫ জন আহত ও হেনস্তার শিকার হন।

আরও পড়ুন: পবিপ্রবিতে বিড়ি খাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ
 
এসব ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন করে হলটির ছাত্রলীগ কর্মীরা। এসময় তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয় এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এছাড়া, গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের কক্ষে এক শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার পাশাপাশি ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে মেরে ফেলার হুমকির অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন: ইবির হলে ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতন ছাত্রলীগের, ভিডিও ধারণ

বিগত দেড় মাসের ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বিতর্কিত কর্মকান্ডে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত দেড় মাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের নেতকর্মীরা ছিনতাই-চাদাবাজি-সংঘর্ষসহ ৩০টিরও বেশি বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়েছেন।

তথ্যমতে, অধিকাংশ সংঘর্ষই হয়েছে হলে সিট দখল এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন প্রায় ৪০ জন। এই সময়ে বেশ কিছু ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগও এসেছে সংগঠনটির নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে দুইজনের বিরুদ্ধে এক দম্পতির কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা এবং এটিএম কার্ড ছিনতাই, আর একজনের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীর কাছে চাদা দাবি করার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সংগঠন থেকে একজনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। 

আরও পড়ুন: ঢাবিতে দম্পতির টাকা ও এটিএম কার্ড ছিনতাই ছাত্রলীগ নেতাদের

এসবের পাশাপাশি ৩ শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিং, দুই শিক্ষার্থীকে শিবির সন্দেহে রাতভর নির্যাতন, দুই ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, কাওয়ালি গানের আড্ডায় যোগ দিতে আসা ছাত্র অধিকার পরিষদের এক নেতাকে মারধর, ক্যান্টিন কর্মচারীর মাথা ফাটানো ও নারী উত্যক্তের অভিযোগও রয়েছে ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

এদিকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি  ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধর, হলে সিট নিয়ে সংঘর্ষসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিদ্যালয়সহ চার বিশ্ববিদ্যালয় ও এক কলেজের ২১ জন নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তারপরও সংগঠনটির নেতাকর্মীদের খারাপ খবরের শিরোনাম বন্ধ হয়নি।

আরও পড়ুন: ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে বহিষ্কার হলেন ঢাবি হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় বিতর্কিত কর্মকান্ডের জেরে আলোচনায় রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। 

গত ৬ জানুয়ারি কথা কাটাকাটির জেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ৩ জন আহত হন। ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ভাইভায় অংশগ্রহণ করতে এসে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হন এক নিয়োগপ্রত্যাশী। তাকে শিবির সন্দেহে মারধর করা হয়। এর প্রায় এক সপ্তাহ পরেই ৩০ জানুয়ারি নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ায় উপাচার্যের দপ্তরে ভাঙচুর করেন ও শাটল ট্রেনের চাবি ছিনিয়ে নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। 

আরও পড়ুন: ভিসি অফিসে ভাঙচুরের পর শাটলের চাবি নিয়ে গিয়েছিল ছাত্রলীগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি হলের এক বৈধ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দিয়ে তার নামে বরাদ্দকৃত সিটে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী এক শিক্ষার্থীকে উঠায় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিছানা এবং জিনিসপত্র সহ প্রশাসনিক ভবনের সামনে আবস্থান নিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিষয়টি সমাধান হয়। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১২ ফেব্রুয়ারি আরও এক শিক্ষার্থীকে হলকক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের কর্মীরা

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থী নির্যাতনে বেপরোয়া রাবি ছাত্রলীগ, রক্ষা পাচ্ছেন না শিক্ষকরাও

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে হলের সিট নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এক ছাত্রলীগ নেতাকে মারধর করে বেঁধে রাখেন আরেক ছাত্রলীগ নেতার সমর্থকেরা। এছাড়া, ৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থী উত্যক্তের প্রতিবাদ করায় অপর এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

৬ জানুযারি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে আহত হন অন্তত ছয়জন। গুরুতর অবস্থায় তিনজনকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখাকে শোকজ নোটিশ প্রদান করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

আরও পড়ুন: উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় নিজ কর্মীকে ‘মারধর’ করলো ছাত্রলীগ

এসব বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে সাংগঠনিক নির্দেশনা রয়েছে, সকলকে এই নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। কেউ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়ালে  তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

একই বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে যাদের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডের প্রমাণ পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যে বা যারাই এধরনের কর্মকান্ডে জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence