ফুড কোর্ট ‘থিংকিং কাপে’র আয়ে পড়াশোনার খরচ চলে ইবির শরীফের

ফুড কোর্ট ‘থিংকিং কাপে’র আয়ে পড়াশোনার খরচ চলে ইবির শরীফের
ফুড কোর্ট ‘থিংকিং কাপে’র আয়ে পড়াশোনার খরচ চলে ইবির শরীফের  © টিডিসি ফটো

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ অনুষদের টুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ শরিফ আহমেদ। ছাত্রজীবন থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সেই স্পৃহা থেকে নিজের প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের গেটের নীচে গড়ে তুলেছেন ফুড কোর্ট ‘থিংকিং কাপে’ (Thinking Cup) যার অর্থ চিন্তার পেয়ালা। শিক্ষার্থীদের মাঝে সুপরিচিত একটি ফুড কোর্ট এটি। যার মাধ্যমে পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি রোজগার করে নিজের খরচ নিজেই বহন করছেন তিনি।

থিংকিং কাপের শুরুটা হয় ২০২৩ সালের পহেলা মার্চে। বাবা মা ভাই সহ ৪ জনের পরিবারে শরীফ সবার ছোট। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের অনেক শিক্ষার্থীকে তার পরিবার থেকে আর্থিকভাবে সাপোর্ট দেয়া হলেও সেরকম কোন সাপোর্ট পরিবার থেকে পাননা শরীফ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই তাকে টিউশনি করে চলতে হতো।

যেহেতু পাঁচ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটি টিউশনি সব সময় থাকে না তাই তার মাথায় চিন্তা আসে বিকল্প কিছু করার। সেখান থেকেই স্বল্প পুঁজি ও পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু করে ইবির জনপ্রিয় এই থিংকিং কাপ নামক ফুডকোর্টটি। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকার বিক্রি হয়। যা থেকে অনায়াসে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয় তার।

থিংকিং কাপের পরিচালক শেখ শরীফ জানান, স্টুডেন্ট লাইফে একটা টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাড় করা খুবই কষ্টসাধ্য একটি বিষয় ছিল। একটা সময় গিয়ে তার মনে হয় যে একটা ইনকাম সোর্সের দরকার যেহেতু বাসা থেকে কোন সাপোর্ট পাননা। একে তো তার ইনকামের একটা মাধ্যম দরকার ছিলো পাশাপাশি রান্নার প্রতি আগ্রহও ছিলো তার। আগে থেকেই টুকটাক রান্না করায় তার মনে হয় যে কিছু ফুড আইটেম করে বিজনেস করলে তার একটা ভালো ইনকাম সোর্স হবে। সে জায়গা থেকেই তার এখানে আসা।

তবে শরীফের এ যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। জানতে চাইলে শরীফ বলেন, ব্যবসায়ী মনোভাবের কারণেই ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে এটি চালু করি। প্রথমে একজন পার্টনার ছিলো। আমার নিজের টাকা, কিছু ফ্যামিলির টাকা, কিছু ধার করা টাকা ছিল। এভাবেই দুজন মিলে শুরু করলেও পরবর্তীতে আমি একাই এটি পরিচালনা শুরু করি।

আমার প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন একজন অথবা দুইজন সহযোগী থাকে যারা খাবার প্রস্তুতির কাচামাল তৈরিতে সাহায্য করে। তাদের মাধ্যমেই আমি হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকি। তাদেরকে আমি চার্জ দেই তবে কাস্টমারের থেকে কোন চার্জ নেইনা। আমার এখানে মূলত বিকেলের নাস্তা, অর্থাৎ, স্ন্যাকস আইটেম আছে; ছোলা, পাস্তা, নুডুলস, চিকেন বার্গার, রঙ চা, দুধ চা, দুধ এগুলো পাওয়া যায়। বিকাল ৫ টা থেকে রাত ১০ টা, প্রতিদিনই খোলা থাকে।

‘থিংকিং কাপে’ নামকরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষুদ্র এই উদ্যোক্তা বলেন, দেখা যায় অবসর সময়েই মানুষ চা খায়, আড্ডা দেয়। চা খেতে খেতে মানুষ চিন্তাভাবনা করে। আমার চিন্তাভাবনা টা এমন ছিলো যে থিংকিং কাপ মানে চিন্তার পেয়ালা। এরকম হবে যে কেও চা ও খেলো, সাথে নিজস্ব কোন চিন্তাভাবনাও করলো। এই ধারণা থেকেই এই নাম দেয়া।

তবে আমারর যে টার্গেট ছিল তা আসলে পূরণ হয়নি। যেমন আমার একটা লক্ষা ছিল যে মানুষ আসবে, ভালো বেচাকেনা হবে, সেগুলোর প্রতিফলন পাইনি। তবে মোটামুটি চলছে। মূলত এখানে হলের কাস্টমার বেশী, তারপরে পুরো ক্যাম্পাসের। পাশাপাশি স্থানীয় কিছু কাস্টমার আছে তবে সেটা অল্প। আমার প্রথম কাস্টমার ছিলো আমার বান্ধবী ও ব্যাচমেট প্রজ্ঞা। ওর কাছে ছোলা ও দুধ চা বিক্রি করেছিলাম।

যেখানে বন্ধুবান্ধবরা অবসরে আড্ডা দিচ্ছে, ট্যুরে যাচ্ছে, বিভিন্নভাবে সময় উপভোগ করছে সেখানে আপনি পরিশ্রম করে নিজে উপার্জন করছেন, বিষয়টি কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে যখন একটা বিজনেস করবেন তখন আপনার উপর প্রেশার থাকবে কিন্তু ব্যাক্তিস্বাধীনতা, নিজের ভালোলাগারও একটা জায়গা থাকবে। মনে হয় যে আমিও একটু ঘোরাফেরা করি, আড্ডা দেই, ট্যুরে যাই কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনার জগৎ আর বাস্তবতা তো সম্পূর্ণ আলাদা।

বেশীরভাগ শিক্ষার্থীকে পরিবার সাপোর্ট দেয় যা আমি পাইনা। সেজন্য আমি ঐ লাইফটা থেকে বের হয়ে বাস্তবতার জগতে ঢুকেছি। বাস্তব জীবনে আজ হোক আর কাল হোক সংগ্রাম করতেই হবে। যদি আগে থেকেই শুরু করি তাহলে সেটা আমার ভবিষ্যতের জন্যও ভালো। পাশাপাশি আমার দৈনন্দিন অর্থিক চাহিদাটাও পূরণ হচ্ছে। সবমিলিয়ে ভালোই আছি।

হলের সামনে দোকান পরিচালনা করা প্রথম ইবিয়ান শরীফ ব্যবসার অভিজ্ঞতা বলতে যেয়ে বলেন, অনেক সময় এমন হয়েছে যে অনেক জুনিয়ররা কিছু বিষিয় নিয়ে ২/১ বাকবিতন্ডা করেছে। আসলে মানুষ মাত্রই ভুল করে, আমিও তার উর্ধ্বে না। ক্যাম্পাস লাইফের প্রথমদিন থেকেই হলে থাকি, সবার সাথে একটা সুসম্পর্ক আছে। আমার হলের প্রভোস্ট স্যারও অনেক হেল্পফুল। যেকোন সমস্যায় সবাই আমকে সাহাযা করেছে।

চিন্তাভাবনা এসন ছিল যাতে আমার হলের বড়ভাই, ছোটভাই, বন্ধুরা যেন কম দামে ভালামানের খাবার পায় এবং আমার হল বাদেও পুরো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা যেন সেবাটা গ্রহণ করতে পারে।

অন্যদের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে শরিফ বলেন, কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাকে স্যালুট জানাই। তবে সে যে বিজনেস করতে চায় সেটা নিয়ে আগে রিসার্চ করতে হবে। তার আগ্রহের জায়গা কতোটুকু আছে সেটা জানতে হবে। আর যেকোন কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকতে হবে, পরিশ্রমী হতে হবে, নিন্দের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। তাহলে যেকোন কাজে সে সফল হবে হনশাআল্লাহ।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে শরিফ বলেন, আরও বড় কিছু করার ইচ্ছে আছে। যা কোনো একটা সমাজে পরিবর্তন এনে দেবে বলে আমার বিশ্বাস। 


সর্বশেষ সংবাদ