৮১ গণরুমের ভোটগুলো আসলে কার?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আসে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকলে তো ভালো, না থাকলে সোজা ঠাঁই হয় আশেপাশের মেসগুলোয়। কিন্তু তাতে তো নাভিশ্বাস। মেস ভাড়া, খাবার টাকার যোগাড় কিংবা অন্যান্য খরচাপাতি- সবমিলিয়ে যেন দিশেহারা হয়ে পড়েন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীরা। ফলে বাধ্য হয়েই একপর্যায়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কাল অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচনে গণরুমের ভোটাররা প্রকৃতপক্ষে কাদের বেছে নেবেন?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হলগুলো দীর্ঘ দশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দখলে। ঠিক একইভাবে বিএনপির আমলেও ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দখলে। সময় পার হয়েছে, ক্ষম এসেছে; কিন্তু গণরুমের চিত্র বদলায়নি। ভাগ্য পরিবর্তন অবহেলিত এই শিক্ষার্থীদের। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে বছরের পর বছর জিম্মি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করেছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা।

সূত্রের তথ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটি হলেই আবাসন সংকট রয়েছে। ফলে প্রত্যেকটিতেই গড়ে উঠেছে অভিশাপের আরেক নাম গণরুম। জানা যায়, বর্তমানে ঢাবির ১৮টি আবাসিক হলে প্রায় ৮১টি গণরুম রয়েছে; যেখানে আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। যাদের অধিকাংশেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী; রয়েছে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়ারাও।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলগুলোতে প্রতিদিন গেস্টরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাজিরা নেওয়া হয়। যারা ছাত্রলীগের নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে না; শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় তাদের। এভাবে হলের শিক্ষার্থীদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করে ক্যাম্পাসে আধিপত্য চালিয়ে থাকে ছাত্রলীগ। একইভাবে করেছে বিএনপি সরকারের আমলে দাপট দেখানো ছাত্রদলও।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ছাত্রলীগ গণরুম ও গেস্টরুমকে ব্যবহার করে, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে ভোট আদয় করে নিতে পারে। বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, আগে ছাত্রলীগ আগ্রাসী আচরণ করলেও সম্প্রতি তারা নমনীয় আচরণ করছে। বঙ্গবন্ধু হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, জানুয়ারির দিকে যে ভাইরা আমাদের স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়েছিলেন; তারাই এখন মায়ের পেটের ভাইয়ের মত আচরণ করছেন। এটা নির্বাচনের পর থাকবে কি-না- সেটাই দেখার বিষয়।

শফিকুল ইসলাম নামে মাস্টার দা সূর্যসেন হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে ভোট কাকে দিবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। ছাত্রলীগের ভাইরা হলে উঠার প্রথম দিকে রূঢ় ব্যবহার করলেও ডাকসু নির্বাচন সামনে আসার পর অনেক ভালো আচরণ করছে। শুধু তাই নয়, গণরুম হলেও তাদের মাধ্যমেই হলে উঠার সুযোগ পেয়েছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রথম বর্ষের একজন ছাত্র বলেন, ভাইরা নিয়মিত রুমে এসে আমাদের বুঝাচ্ছেন। বলছেন, যে ছাত্রলীগ যেহেতু আমাদের থাকার জায়গা দিয়েছে সেহেতু ছাত্রলীগকেই আমাদের ভোট দিতে হবে। অসৎ আটরণে জন্য ক্ষমাও চাইছেন অনেকে।

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রথম বর্ষের আরেক শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গত দুই মাস আগের পরিস্থিতির সাথে বর্তমান পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। গেস্টরুমের কঠোরতা অনেকটা কমেছে। তবে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা নির্দেশনা তাঁদের দেওয়া হচ্ছে। হল সংসদে কে কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তা মুখস্থ করানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের দ্বিতীয় বর্ষের একজর ছাত্র বলেন, যে নেতা রাতে টিএসএসিতে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় আমাদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, সেই ভাই এখন রুমে এসে আবেগঘন কথা বলছেন, সংস্কারের কথা বলছেন।

অনেক হলের গণরুমের শিক্ষার্থীরা আবার বলছেন, তারা ১১ই মার্চের নির্বাচন নিয়ে অনেকটা ভয়ের মধ্যে আছেন। তারা মুখে কিছু না বলে ব্যালটের মাধ্যমে জবাব দিতে চান। নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় এবং গণরুমের শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ পান, তবে রাজনীতির ভিত্তিতে নয়, পছন্দের নেতাদেরকেই তারা ভোট দেবেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক ছাত্রনেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ব্যক্তিগত ইমেজ বা কারিশমায় এ নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনা কঠিন। কেননা এ জন্য কেউ পর্যাপ্ত সময় পায়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কারো যদি সেই সাংগঠনিক ও বিশ্লেষনী ক্ষমতা থাকে এবং পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পান; তবে তিনি বা তারা জয় পেতে পারেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাল অনুষ্ঠেয় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে কোন একটি পক্ষ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ভিপি পদে ছাত্রলীগ কিংবা কোটা সংস্কারকারীদের প্রার্থীদের একজন, জিএস পদে ছাত্রলীগ অথবা ছাত্রদল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একজন এবং এজিএস পদে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের প্রার্থীদের মধ্যে একজন নির্বাচিত হতে পারেন।


সর্বশেষ সংবাদ