তীব্র আবাসন সংকট আর চতুর্মুখী সমস্যায় জর্জরিত জবি শিক্ষার্থীরা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। প্রতিষ্ঠার ১৯ বছরেও নানা সংকটে জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষা ও গবেষণায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করলেও নেই পর্যাপ্ত পরিবহন, ক্যান্টিন, ল্যাব, লাইব্রেরি ও মেডিকেল সুবিধা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় মেসে নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এমনকি থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে না পারায় পড়াশোনা বাদ দিয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক।

জানা যায়, ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল, ১৮৭২ সালে জগন্নাথ স্কুল, ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ কলেজ এবং পরবর্তীতে ২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় এই প্রতিষ্ঠানটি। ১১টি হল থাকলেও সবগুলোই আছে বেদখল অবস্থায়। দুটি হল আবাসযোগ্য হলেও নেই প্রশাসনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ।

শিক্ষার্থীরা জানান, হল-আবাসন সংকটের ফলে পুরান ঢাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উচ্চমূল্য দিয়ে থাকতে হয় অনেককে। আয়ের উৎস যে টিউশনি, সেটাও জোটে না অনেকের কপালে। এক বেলা খেয়ে, দুই বেলা না খেয়ে দিন পার করেন অনেক শিক্ষার্থী। অনেকে কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। ফলে সুদূর নরসিংদী, কুমিল্লা, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জ থেকে নিয়মিত ক্লাস করেন। এতে তাদের স্বাস্থ্য ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  

‘আমরা মাত্র ৬ মাস হয় এসেছি। এর মধ্যে হল বানানো সম্ভব নয়। আমরা ইউজিসির কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। কোন সংশোধন প্রয়োজন হলে তারা করে কাজ শুরু করবেন। এতদিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল। সেদিক থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হয়েছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি, এ বছরের মধ্যে একাধিক হল পাব।’-জবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতির পর থেকে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন করে গেছে। ২০১৩, ২০১৮ এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের রেশ ধরে ২০২৪ সালে হল ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের দাবি নিয়ে বড় আন্দোলনে মাঠে নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ ১২ এবং ১৩ জানুয়ারি টানা দু’দিন তিন দফা দাবি নিয়ে গণ-অনশনে বসে শিক্ষার্থীরা।  

আরো পড়ুন: যমজ যারীন-যাহরা পড়বেন বুয়েট ও মেডিকেলে

অনশনের তিন দাবির প্রথম দাবি ছিল, সেনাবাহিনীর কাছে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ হস্তান্তরের চুক্তি অনতিবিলম্বে স্বাক্ষর করতে হবে। দ্বিতীয় দাবি ছিল, পুরান ঢাকার বাণী ভবন ও ড. হাবিবুর রহমান হলের স্টিল বেইজড ভবনের কাজ দ্রুত শুরু এবং শেষ করতে হবে। তৃতীয় দাবি ছিল, যত দিন অবধি আবাসনব্যবস্থা না হয়, তত দিন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।  

শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, এমন অবস্থানের পর প্রথম দাবি মেনে নিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ হস্তান্তর করা হলেও আবাসন সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের দুটি প্রাণের দাবির দিকে ভ্রূক্ষেপ করা হয়নি। খাতা-কলমে নেই কোনো উদ্যোগ, নেওয়া হয়নি কোনো বাস্তবায়ন পরিকল্পনা।

এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ আর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে নিয়মিত কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে দর্শন বিভাগের এক শিক্ষার্থী ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরলেও অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। 

অসুস্থ শিক্ষার্থীর এক বন্ধু জানান, তিনি প্রতিদিন নরসিংদী থেকে এসে ক্লাস করে। আজকে দুপুর পর্যন্ত সে কিছুই খায়নি। লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিল। তাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। ওকে হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলি। ফেরার সময় সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

আরো পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন করতে চাই, এতে কোনো সন্দেহ নেই: ঢাবি ভিসি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমি প্রায় দেড় বছর কুমিল্লা থেকে বাসে আসা-যাওয়া করেছি। পুরান ঢাকার মেস বাসায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, কারণ আমার ক্লসট্রোফোবিয়া আছে। আমি আবদ্ধ, ঘিঞ্জি জায়গায় শ্বাস নিতে কষ্ট পাই। কিন্তু বাসে নিয়মিত আসা-যাওয়ার কারণে ধুলাবালিতে আমার অ্যাজমা ধরা পড়ে, যা আগে ছিল না। এছাড়া, ফুসফুসে নডিউলও ধরা পড়ে, যা প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে ক্যান্সারে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই অসুস্থতার চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি, কারণ সারা বছর চিকিৎসা ও ওষুধ নিতে হচ্ছে।

পুরান ঢাকার মেস জীবনের করুণ অবস্থা জানিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাতুল ইসলাম নাইম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে বলেন, ‘পুরান ঢাকার মেস জীবন এক কঠিন বাস্তবতা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে হল না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর ও নিম্নমানের মেসে গাদাগাদি করে থাকেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছোট, স্যাঁতসেঁতে ঘর, আলো-বাতাসের অভাব, নিম্নমানের খাবার ও অপর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থার মধ্যেই তাদের দিন কাটে। একটি বাথরুম ব্যবহার করতে হয় ১০-১৫ জনকে, ফলে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। বাড়িওয়ালার বিধিনিষেধ, অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধি ও অবহেলা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট দূর না হলে শিক্ষার্থীদের এ দুর্ভোগ চলতেই থাকবে।’

আরো পড়ুন: ‘নো পিএইচডি, নো প্রফেসর’ নীতির বাস্তবায়ন করতে হবে: প্রেস সচিব

ইতিহাস বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী নাহিন জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের দিন শুরু হয় দুপুর থেকে, সকালের নাস্তা খুব কমই করি। আসলে দুপুর-রাত দু'বেলা দুমুঠো ভাত জুটাতেই হিমশিম খাই। আমাদের দেখার কেউ নাই, সবাই নিজের উদর পূজায় ব্যস্ত। জবিয়ানরা এতিম যেন, প্রশাসন সৎমা। পঁচে পিষে মরে, তবু খবর নেয় না। খিদের নিদারুণ জ্বালায় মানুষের চক্ষুলজ্জা লোপ পায়। লোপ পেয়েছে চক্ষুলজ্জা, লোপ পেয়েছে শরম। আমরা—তোমাদের ঢাকার বুকে আধমরা অধম।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. শেখ গিয়াসউদ্দিনকে ফোন কলে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দেবেন না জানিয়ে কল কেটে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা মাত্র ৬ মাস হয় এসেছি। এর মধ্যে হল বানানো সম্ভব নয়। আমরা ইউজিসির কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। কোন সংশোধন প্রয়োজন হলে তারা করে কাজ শুরু করবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এতদিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল। সেদিক থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হয়েছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি, এ বছরের মধ্যে একাধিক হল পাব।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence