ইউল্যাবের আন্দোলনে বিভক্তি, দু’পক্ষের কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনার শঙ্কা
- আলামিন ইভান
- প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:৪২ PM

উপাচার্যের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন দেশের অন্যতম বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি তারা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। একইদিন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নেন আরেকদল শিক্ষার্থী।
প্রশাসনের আশ্বাসে সেদিন আমরণ অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানলে বড় আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। অপরদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন ভিসির পক্ষে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান, যেকোন সময় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, ইউল্যাব প্রাঙ্গণে গ্রাফিতি আঁকায় সম্প্রতি দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য তা প্রত্যাহার করা হয় বলে জানা যায়। এই ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। গত ২ জানুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবিতে একদল শিক্ষার্থী আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদের মধ্যস্থতায় কয়েকটি দাবি বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টারের কাছে জমা দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের দাবি পূরণ এবং একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার আশ্বাস দেয়া হলে ওই দিন রাত সাড়ে ১০টায় অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা। অপরদিকে একইদিন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নেন আরেকদল শিক্ষার্থী। উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নেয়া আরেকদল শিক্ষার্থীর অভিযোগ, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ফ্যাকাল্টি মেম্বারসহ অন্যান্য স্টাফদের সাথে অশোভন আচরণ করেছেন। কাউকে হয়রানি কিংবা অপদস্থ করে নয়, শিক্ষার্থীসূলভ আচরণের মাধ্যমে দাবি আদায়ের আহবান জানান তারা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ইউল্যাব প্রশাসন শিক্ষার্থীদের দাবিকে উপেক্ষা করে ফ্যাসিবাদী আচরণ বজায় রেখেছে। উপাচার্যের নেতৃত্বে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি, গ্রাফিতি আঁকার কারণে শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান ও শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠনের নামে আমাদের সাথে প্রহসন শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেমিস্টার ব্রেক চলছে, ক্যাম্পাস খুললেই বড় ধরনের আন্দোলনে যাবেন তারা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আসিফ মাহামুদ বলেন, আমরা কোনো প্রহসনের তদন্ত চাই না। আমরা চাই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি। আমাদের একটি প্রতিনিধিদল ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষকের সাথে কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। গত বৃহস্পতিবার থেকে সেমিস্টার ব্রেক শুরু হয়েছে। বন্ধের মধ্যে যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসির কাছ থেকে সন্তোষজনক পদক্ষেপ গ্রহণ না দেখতে পাই, সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাস খুললে দাবি আদায়ে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক আসবে বলে জানান তিনি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ দ্বারা ফ্যাকাল্টিদের অপমান, অপদস্থ ও হেনস্থার প্রতিবাদে র্যালি এবং মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচিতে অংশ নেয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, গত ১ জানুয়ারি ইউল্যাবের কতিপয় শিক্ষার্থী ভিসির পদত্যাগ সহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করেন। দাবি আদায়ে তারা প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এডমিন, কর্তৃপক্ষের একাংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রকার জোর আটক করে রাখেন।
এ সময় কতিপয় শিক্ষার্থী বিভিন্ন পুরুষ ও নারী ফ্যাকাল্টিদের অপমান, অপদস্থ ও হেনস্তা করেন। সেদিন এমন অনেক শিক্ষক অপদস্থ হয়েছেন, যারা জুলাই আন্দোলনে সরাসরি শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জানায় শিক্ষকরা। এসময় শিক্ষকদের অসম্মান এবং ক্যাম্পাসে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার নিন্দা এবং দোষীদের শাস্তির দাবি জানান তারা।
উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নেয়া অপর অংশের শিক্ষার্থীদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়টির বিবিএ বিভাগের শিক্ষার্থী আল-মাহমুদ পাটোয়ারি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরাও কর্মসূচি ঘোষণা করব। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সমন্বয়ক আমাদের ইন্টারনাল ব্যাপারে কথা বলতে আসছিল কিন্তু আমরা সেটা মানি না। সমন্বয়ক নিজেরাই এখানে বহিরাগত।
তিনি আরও বলেন, আমরা সমন্বয়ককে মাসউদ হান্নানকে বসে আলোচনা করতে বলি কিন্তু তিনি তা করেননি। আমাদের সাথে কথা শেষ না করেই তিনি আবার আন্দোলনকারীদের সাথে বসে গেছেন। ইজিসিতে থেকে যে তদন্ত করা হবে, আমরা চাই সেখানে যেন কোনরকম রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে। তদন্ত করে যদি কোন সঠিক কারণ বা যৌক্তিক কারণ থাকলে সে ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত আসবে আমরা মেনে নেব।
তিনি বলেন, এই আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে অনলাইন প্লাটফর্মে একটি পোল ক্রিয়েট করা হয়েছিল। সেখানে কয়েকটি ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের মতামত চাওয়া হয়। তার মধ্যে একটি ছিল, ‘আপনি কি বর্তমান ভিসি ইমরান রহমানকে সমর্থন করেন?’। এখানে প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতামত ভিসির পক্ষে দেন। আর মাত্র ১৫ শতাংশ ভিসির পদত্যাগ চান। মাত্র অল্পসংখ্যাক শিক্ষার্থীর কারণে তো এরকম বিশৃঙ্খলা মেনে নেয়ার মত না।
শিক্ষার্থীদের ৫ দফা দাবিগুলো হলো-জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে অসম্মান এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানির দায় নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে; ফ্যাসিবাদের দোসর ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে; ডিসিপ্লিনারি কমিটি ও প্রক্টরিয়াল বডির সবাইকে ছাত্র বিরোধী সিদ্ধান্তের দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে; শিক্ষার্থীসহ সকল অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে ইউল্যাবের কোড অব কনডাক্ট যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে এবং মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাকে হরণ করে, এমন সকল কলা কানুন ইউল্যাবের আইন কাঠামো থেকে বিলোপ করতে হবে।