মৃত্যুর আগে তরুণদের ক্যারিয়ার নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা জানান হাদি

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি  © সংগৃহীত

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে একটি ভিন্নধর্মী ও দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন লালন করতেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে গত ৮ ডিসেম্বর দেশের একটি বেসরকারি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তরুণদের ভবিষ্যৎ, কর্মসংস্থান সংকট, বিসিএসকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা এবং উদ্যোক্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

সাক্ষাৎকারে শরিফ ওসমান হাদি বলেন, তিনি আপাতত কয়েকটি বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা রাখেন, যার একটি হলো দেশের তরুণদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে, অনার্সের সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ার বা ফাইনাল ইয়ারে পড়েও অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানে না, অনার্স শেষ করার পর তারা কী করবে। এ অবস্থাকে তিনি ভীষণ হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেন।

হাদি বলেন, বাংলাদেশে কার্যত একটি মাত্র লক্ষ্য তৈরি করে রাখা হয়েছে—বিসিএস। প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী আবেদন করে, অথচ নেওয়া হয় মাত্র দুই হাজার থেকে দুই হাজার দুইশ’ জন। এতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় নষ্ট হয়ে যায়। বিসিএসের প্রতি এই মোহ কেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, নবম গ্রেডের একজন ক্যাডার কর্মকর্তার প্রাথমিক বেতন ২৬ থেকে ২৭ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা—যদি সে ঘুষ না খায়, হারাম উপার্জন না করে।

আরও পড়ুন: বাবা শিক্ষক, ভাই ইমাম ও খতিব—৬ ভাই বোনের ‘হাদি পরিবারে’ কে কী করেন?

তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডার বা পুলিশ ক্যাডার ধরে নিলেও বেতন ৫০ হাজার, মিটিং-টিটিং যোগ করে ৬০ হাজার টাকার মতো হতে পারে। অথচ বাংলাদেশে এমন অসংখ্য প্রাইভেট জব আছে, যেখানে এক লাখ টাকার বেশি সম্মানজনক বেতন পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও কেন তরুণরা পাঁচ বছর নষ্ট করে বিসিএসের পেছনে ছোটে, ক্যাডার হতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে—এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি গত ১৫ বছরের বাস্তবতা তুলে ধরেন।

হাদি বলেন, এই সময়ে বাংলাদেশে যার পরিবারে একজন পুলিশ ক্যাডার আছে, সে গুম, খুন বা ক্রসফায়ারের মতো বিপদ থেকে নিরাপদ থাকে। যার পরিবারে একজন প্রশাসন, ট্যাক্স বা কাস্টমস ক্যাডার আছে, তার সঙ্গেও এসব ঘটনা ঘটে না। থানায় গিয়ে জিডি করতেও হলে ক্যাডারে আত্মীয় না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে সেটিও করা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, এখন নতুন লড়াই হলো—আপনি যেই রাজনৈতিক দলেরই হোন, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হলেও অন্যায় হলে থানায় গিয়ে মামলা বা জিডি করতে পারেন কি না। তিনি দাবি করেন, যদি বিসিএস প্রশাসন, পুলিশ, ট্যাক্স বা কাস্টমস ক্যাডার হয়ে কেউ এক পয়সা হারাম খেতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ বিসিএস পরীক্ষাই দিতে চাইবে না। কারণ ৪৫ হাজার টাকার বেতনে ৯০ হাজার টাকার ঘড়ি পরলে দুদক প্রশ্ন করবে এই ঘড়ি কোথা থেকে এলো। তখন সে জীবনযাপনই সম্ভব হবে না।

এই বাস্তবতায় সমাধান হিসেবে উদ্যোক্তা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন হাদি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব সরকারই আজীবন বলে এসেছে—উদ্যোক্তা হও। কিন্তু বাস্তবে উদ্যোক্তা হতে গিয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যাংকে আবেদন করলেও পাঁচ লাখ টাকার ঋণের জন্য ঘুষ ও জটিল প্রক্রিয়ার মুখে পড়তে হয়। দুই নম্বর পথে গেলে সব অনুমোদন পাওয়া যায়, কিন্তু সুষ্ঠু পথে গেলে উদ্যোগ নেওয়াই সম্ভব হয় না।

এই প্রেক্ষাপটে নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে শরিফ ওসমান হাদি বলেন, তার লড়াই অন্তত পাঁচ হাজার তরুণকে স্কিল-বেজড ট্রেনিং দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনার লক্ষ্য ছিল তার। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অন্তত ১০টি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা এই উদ্যোগে তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

হাদি জানান, এই প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকবে ভাষা শিক্ষা—ইংরেজি, আরবি, ফরাসি, জাতিসংঘের তিনটি ভাষা এবং চীনা। তিনি বলেন, চীন একটি বড় বাজার, ইউরোপে স্প্যানিশ ও ফরাসির বিশাল চাহিদা রয়েছে। আরবি ভাষাকে বাংলাদেশে শুধু ধর্মীয় পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, অথচ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ভাষা জানলে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ভাষা না জানার কারণে অনেক বাংলাদেশি সেখানে ভালো আয় করতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আরও পড়ুন: কাঁধে থাকা সেই শিশুটি হাদির সন্তান নয়, জানা গেল পরিচয়

নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে হাদি বলেন, তিনি নিজে ১০ বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা পড়িয়েছেন। তিনি নিজেই ট্রেনিং দেবেন, তার টিম গড়ে তুলে বিভিন্ন ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এর পাশাপাশি আইসিটি কেন্দ্রিক বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং দিয়ে অনার্স পড়াকালীনই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি গাইডলাইন পাবে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ১০টি প্রতিষ্ঠান তার এই পরিকল্পনা শুনে যোগাযোগ করেছে এবং উদ্যোগ শুরু হলে বিনামূল্যে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তরুণদের এমপাওয়ার করার পাশাপাশি ঢাকা কার্টের কোনো প্রান্তে চাঁদাবাজি বন্ধের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। বড় সিন্ডিকেট পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে কি না জানেন না জানিয়ে অন্তত দুইটি কাজ তিনি নিশ্চিতভাবে করতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গত, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে দুর্বৃত্তরা শরিফ ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করে। তিনি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক এবং ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান। শুক্রবার সন্ধ্যায় তার মরদেহ দেশে আনা হয়।

পরে শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে সমাহিত করা হয়। জাতীয় কবির পাশেই তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ২টা ৩৩ মিনিটে অনুষ্ঠিত ওই জানাজায় সারাদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার হাজারো মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে দুপুর ৩টার দিকে হাদির মরদেহ বহনকারী গাড়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকায় নেওয়া হয়।

হাদির জানাজার নামাজ পড়ান তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। এ সময় পুরো এলাকায় শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!