৩.৫৭ সিজিপিএ নিয়ে অনার্স পাস করলেন আব্দুল কাদের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬ AM , আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২১ AM
দারিদ্র্যের চক্র থেকে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ সেশনের ছাত্র আব্দুল কাদের ৩.৫৭ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক শেষ করেছেন। তবে তার শিক্ষাজীবনের চেয়েও বেশি আলোচিত হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব।
লক্ষ্মীপুরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া কাদেরের ছোটবেলা কেটেছে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। মায়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও বাবার সিকিউরিটি গার্ডের সীমিত আয় দিয়ে তাকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়েছে। ঢাকা কলেজ থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই ছিল সংগ্রামের গল্প।
আব্দুল কাদের
কাদেরের জন্মের আগে তার বাবা, আব্দুর রহমান সাত বছর ধরে একটি সন্তান কামনা করেছিলেন এবং তার ইচ্ছা পূর্ণ হলে তাকে হাফিজ বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। লক্ষ্মীপুরের মান্দারী ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করা ও বেড়ে ওঠা কাদেরের প্রাথমিক শিক্ষা হাফেজ হওয়ার পথকেই অনুসরণ করেছিল। তিনি এক বছরেরও বেশি সময় চেষ্টা করেছিলেন হাফিজ হতে। কিন্তু এটি তার জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় তিনি সাধারণ মাদ্রাসায় চলে যান এবং পরে জাতীয় পাঠ্যক্রমে যোগদান করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন।
কলেজ জিবন শেষ করে নিজের পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে আব্দুল কাদের ২০১৮-১৯ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি বি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৩৬৬তম স্থান অর্জন করে। তিনি তার প্রিয় বিষয় আইন নিয়ে পড়তে চাইলেও সুযোগ না হওয়ায় তিনি পরবর্তীতে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।
তবে কাদেরের মা চেয়েছিলেন, তার ছেলে একজন আইনজীবী হোক। কাদেরের মা চেয়েছিলেন, তার ছেলে আইনজীবী হয়ে ন্যায়বিচারের প্রতীক হোক। যদিও ইংরেজিতে কিছুটা দুর্বলতার কারণে আইন কিংবা পছন্দের দ্বিতীয় বিষয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ার সুযোগ পাননি। তবু হাল না ছেড়ে নিজের বিভাগে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান।
আব্দুল কাদের মজার ছলে নিজের বিভাগকে ‘আজিমপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ বলতেন কারণ তার ইনস্টিটিউটের ভবন ছিল আজিমপুরে, মূল ক্যাম্পাস থেকে দূরে।
তিনি ঢাকায় হলে ও আজিমপুরে আত্মীয়দের বাড়িতে থাকতেন। তিনি অবশেষে বিজয় একাত্তর হলে ওঠার সুযোগ পান, যেখানে ছাত্রলীগ নেতা আবু ইউনুসের অধীনে একটি গনরুম প্রায় ১০০ জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হত তাকে। আবু ইউনুস বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আক্রমণাত্মক ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত।
২০২০ সালে কাদের একটি বড় ধাক্কা সহ্য পান যখন তার বাবার চাকরি চলে যায়। কাদেরের ওপর দায়িত্বের বোঝা আরও বাড়তে থাকে এবং তিনি নিজেকে ও পরিবারকে সহায়তা করতে কাজ করা শুরু করেন। তিনি সাভারের একটি গার্মেন্ট কারখানার কাটিং বিভাগে কাজ শুরু করেন এবং পরে একটি মাস্ক কারখানায় যান, যেখানে তিনি কোনোরকমে টিকে থাকার মতো অর্থ উপার্জন করতেন। কাদের বলেন, যেকোনোভাবে আমাকে টাকা রোজগার করতে হত। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়, যখন কোনো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ছিল না, তখন এটি তার জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।
২০২২ সালের মধ্যে কাদের বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন এবং ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ ও আখতার হোসেনের মতো নেতাদের সঙ্গে কাজ করেন। সেই বছর, তারা আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার জন্য একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, যা ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে পরিণত হয়। কাদের এবং ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এটি ছিল তার প্রথমবারের মতো জেলে যাওয়া। তিনি কেরানীগঞ্জ কারাগারে ৩১ দিন কাটান, যা তার মতে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই সময়ে তার পরিবারের আর্থিক সংকট অব্যাহত ছিল।
মা প্রায়ই তাকে সতর্ক করতেন, তুমি যদি মারা যাও, আমাদের আর কোনো আশা থাকবে না। কিন্তু কাদের জানতেন কীভাবে মায়ের কথার উত্তর দিতে হবে: তাহলে তুমি কি চাও, আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বন্ধ করি?" এটি তার মাকে বাকরুদ্ধ করে দিত কারণ তিনি জানতেন, তার শেখানো কথাগুলোই কাদের তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। তাদের সংগ্রামী জীবনে একমাত্র জিনিস যা তিনি তার ছেলেকে শিখিয়েছিলেন তা হলো, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো।
কাদের তার বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই উচ্চ আদালত ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া সরকারি চাকরির জন্য কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করলে তিনি ২৪ সালের ৫ জুন প্রতিবাদ করেছিলেন। তখন তিনি জানতেন না, এটি একটি বিশাল বিপ্লবে পরিণত হবে।
স্নাতক শেষ করে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে তুলে ধরেন নিজের কষ্টের গল্প। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট, আলহামদুলিল্লাহ! আমার মতো নিন্মবিত্ত পরিবারের ছেলের পক্ষে এতোদূর আসা কখনোই সম্ভব হইতো না; কেবল মায়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তির কারণেই সম্ভব হইছে। টাকা পয়সা নাই; তবুও ছোটবেলা থেকেই আমার মা আমাকে সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন৷ একটু বেতন কমানোর জন্য আমি এবং মা ঘন্টার পর ঘন্টা প্রিন্সিপালের রুমে বসে থাকতাম। কনকনে শীতের রাতে বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে দারোয়ানি করে আমার বাবা আমাকে পড়িয়েছেন, এখনো চলমান।
তিনি আরও বলেন, বাবার সিকিউরিটি গার্ডের বেতন দিয়ে পরিবার চালানো দায়; এতোদূর আসার ক্ষেত্রে আমার বড় মামা আর আন্টি-আংকেলরা যদি আর্থিক সহায়তা না করতো; না খেয়ে টিকে থাকাও দায় হয়ে যাইতো। আমার ছোট মামা আমার মেন্টর, গ্রাম থেকে ঢাকা কলেজে নিয়ে আসা, ঢাবিতে যাওয়া, সবকিছুর পেছনে তাঁর একনিষ্ঠ গাইডলাইন ছিল, এমনকি ঢাকা আসার পর আমার সবধরনের চিন্তা ছিল তাঁর মাথায়। আমি একটু অগোছালো মানুষ, নিজের ক্যারিয়ার-পরিবারের প্রতি আমি বেখেয়াল; সমাজ এবং দেশ উদ্ধার কাজে আমার মন। যাইহোক, জেল-জুলুম, বিপ্লব পেরিয়ে অবশেষে অনার্স জীবন শেষ হইলো। সবচেয়ে বড় পাওয়ার বিষয় হইলো, ছাত্র জীবনে হাসিনার পতন দেখে যেতে পারছি, শুকরিয়া!
উল্লেখ্য, আবদুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করার পর মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তার পরিবার এবং পিতামাতা অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু তারা এখন খুশি কারণ মানুষ তাদের সম্মান এবং প্রশংসা করছে।