‘স্রোতের বিপরীতে চলে’ শান্তিতে নোবেল জয়

 নার্গিস মোহম্মদী
নার্গিস মোহম্মদী  © ফাইল ছবি

ইরানের মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে বছরের পর বছর ধরে আপসহীন অবস্থানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেলের জন্য নার্গিস মোহম্মদীকে মনোনীত করেছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। শুক্রবার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে চলতি বছরের নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণার সময় নার্গিসকে ইরানের সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের ‘অবিসংবাদিত নেতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন নোবেল কমিটির প্রধান বেরিত রেইস-অ্যান্ডারসেন। এছাড়াও তাকে অবিলম্বে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে ইরানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীকে আহ্বান জানানো হয়েছে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে।

ইরানে সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার জন্য নার্গিসকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির বিচার বিভাগ। বর্তমানে ইরানের এভিন কারাগারে বন্দি আছেন তিনি। পেশায় আইনজীবী নার্গিস মোহম্মদী ইরানের মানবাধিকার সংস্থা দ্য ডিফেন্ডার্স অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের উপপ্রধান। এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধানের নাম শিরিন এবাদি, যিনি ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন।

চলতি বছর ১০৫তম ব্যক্তি এবং ১৯তম নারী হিসেবে শান্তিতে নোবেল পেলেন নার্গিস। এর আগে ১৯০১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শান্তি ও মানবতা সংক্রান্ত বিভিন্ন খাতে অবদানের জন্য নোবেল জয় করেছেন মোট ১০৪ জন। ইরানের কারাবন্দি মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী নার্গিস মোহাম্মাদি নোবেল জয়কে দেশটির কট্টর ইসলামপন্থি শাসকগোষ্ঠীর জন্য ‘উপযুক্ত জবাব’ এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রেরণা হিসেবে দেখছেন অনেকে। 

পদার্থবিদ নার্গিস মোহাম্মদী ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল ইরানের জাঞ্জানে জন্মগ্রহণ করেন। কোরভেহ, (কুর্দিস্তান), কারাজ ও ওশনাভিয়েহ শহরে শৈশব কাটে তার। ইমাম খোমেনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ে একজন পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি জীবনে পদার্পণ করেন। তিনি শিক্ষাজীবন থেকেই সংবাদপত্রে নারীর অধিকার নিয়ে লেখালেখি করে আসছেন।

তার এ প্রাপ্তি নিয়ে নোবেল কমিটির প্রধান বেরিত রেইস অ্যান্ডারসেন বলেন, গত বছর ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’ নামে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন নার্গিস, তা ইতোমধ্যে ইরানে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার লাখ লাখ নারীর প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।

এ পুরস্কার সেই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নার্গিস মোহম্মদী সংগ্রামী জীবনের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যদি ইরানের সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে তারা নার্গিসকে মুক্তি দেবে এবং তিনি যেন এই পুরস্কার গ্রহণ করতে এখানে আসতে পারেন— সেজন্য সহযোগিতা করবে—জানান নোবেল কমিটির প্রধান।

তবে ইরানের ক্ষমতাসীন কট্টর ইসলামপন্থী সরকার যে নার্গিসের নোবেল জয়ে সন্তুষ্ট নয়, তা বলাই বাহুল্য। শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের কোনো সংবাদমাধ্যম নার্গিস মোহাম্মাদির নোবেল জয়ের সংবাদ প্রকাশ করেনি। এর বেশ কিছুক্ষণ পর দেশটির আধা সরকারি সংবাদমাধ্যম ফার্স এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য পশ্চিমাদের কাছ থেকে পুরস্কার পেলেন নার্গিস মোহাম্মাদি।

নার্গিসের স্বামী তাঘি রাহমানি তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, নোবেল পুরস্কার যে নার্গিসকে আরও উৎসাহিত করবে— তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এ পুরস্কার আসলে তার ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’ আন্দোলনের পুরস্কার।

এ নিয়ে নার্গিসের নিজ দেশে ইরান ও ইরানের বাইরে নানা আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তার মতে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নার্গিস মোহম্মদী স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ। মানুষের কল্যাণে বিশেষ করে নারী স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছেন, জেল খেটেছেন কিন্তু পিছু হটেননি।

এই পর্যন্ত ১৩ বার জেলে গিয়েছেন এবং ৩০ বছরের বেশি জেল মাথায় নিয়ে স্রোতের বিপরীতে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। আপস করলে ভালো খেতে পারতেন, আরামে থাকতে পারতেন, জেলে কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু তাতে মানুষের কল্যাণ হতো না। মানুষ তাকে চিনতো না। এখন তিনি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। আফগানিস্তানে এমন নারী আছে। দুঃখজনক হলো আমাদের দেশে এমন সাহসী নারী নেই বলেও আক্ষেপ জানান এই শিক্ষক।


সর্বশেষ সংবাদ