এশিয়ান কাপে খেলবে মেয়েরা, তাদের সাফল্যে সমাজের অবদান কী?
- মোজাফ্ফর হোসেন
- প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৫:৪৩ PM , আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০২:১৩ PM

মিয়ানমারকে হারিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই প্রথমবার এশিয়ান কাপ মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই মেয়েরা এর আগে টানা দুইবার সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাদের এই অর্জন দেখে ভাববার কোনো কারণ নেই তাদের সঙ্গে গোটা বাংলাদেশ খেলেছে। এর পেছনে আমাদের সামষ্টিক কোনো অবদান নেই, যেটা হয়তো ছেলেদের ফুটবল বা ক্রিকেট আছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে কেন নেই, সেটাই ব্যাখ্যা করছি।
এই মেয়েরা প্রত্যেকে ফুটবল খেলতে এসে নানাভাবে সামাজিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন। এই যে মেয়েদের এত বাহবা দিচ্ছি, অথচ তারা খেলা শেষ করে ঘরে ফিরলে অনেক পরিবারই তাদের পুত্রবধূ করতে চায় না। নানা রকম কথার বানে তারা জর্জরিত হতে থাকে। কটূক্তির শিকার হতে হয়। শারীরিকভাবে হামলার শিকারও হয়েছেন!
এর উপর আছে অভাব, অনিশ্চয়তা! মূল দলে খেলে মাত্র কয়েকজন, কিন্তু জাতীয় দলের বাইরে গেলেই ঠিকমতো মাইনে জোটে না, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও জোটে না স্পন্সর, স্টারডম। অনিশ্চয়তা থেকে বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়েও খেলেছেন সাফজয়ী রাজিয়া। পরে সন্তান জন্ম দিয়ে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন তিনি।
মনে পড়ে ২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে সানজিদা ফেসবুকে লিখেছিলেন: ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’
ছেলেদের ক্রিকেট/ফুটবলে প্রতিটা থানা থেকে খেলোয়াড় উঠে আসে। তেমনটি কিন্তু এই মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। গোটা দেশ তো দূরে থাক, নারী ফুটবল দলের অধিকাংশ ফুটবলারই প্রায় একটি গ্রাম থেকে আসা। গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উঠে এসেছে একদল ফুটবল কিশোরী।
২০২২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের পাঁচ খেলোয়াড়ই ছিল রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের। তার মানে ভাবার কোনো অবকাশ নেই প্রতিযোগিতা কম বলে অযোগ্যরা জাতীয় দলে খেলছে। গত সাফে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন ঋতুপর্ণা চাকমা। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়া সেরার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি।
গত ম্যাচেও মিয়ানমারের বিপক্ষে দুটি গোল করেছেন তিন। সাফে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলকিপার হয়েছিলেন রূপনা চাকমা। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন মনিকা চাকমা।
বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হয়েছেন জয়া চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম কোনো সংগঠক হিসেবে ফিফার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।
মূলত নারী ফুটবলে বাংলাদেশকে জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে পাহাড়ি মেয়েরা। মাঠে আদিবাসী, বাঙালি, হিন্দু, মুসলিম মিলে চমৎকার সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ওরা, হারিয়েছে ভারতের মতো বৃহত্তর রাষ্ট্রের একটি দলকে।
একবার ভেবে দেখুন তো, একই সম্প্রীতি যদি মাঠের বাইরে গোটা দেশে বিরাজ করে তাহলে দেশ কোথায় যাবে? হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং বাঙালি-চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা-ত্রিপুরা-খীসা-মারমা-পাংখোয়া-গারো-খুমী-ম্রো-রাখাইন-ম্রং-মনিপুরী-হাজং-কুর্মি-সাঁওতাল-ওরাঁ প্রত্যেক একসঙ্গে একটা বল নিয়ে ছুটছে, পাস দিচ্ছে একে অন্যকে—ধর্ম আলাদা, ভাষা আলাদা কিন্তু জার্সি এক, মিশন এক—গোল হবে না? না হোক, একসঙ্গে একসুরে সবাই কাঁদতে তো পারবো?
ফুটবলের শক্তি মূলত এটাই। আর এই মেয়েরা ক্রিকেট/ফুটবল খেলছে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বিপক্ষে না, পাশাপাশি এই সমাজব্যবস্থার বিপক্ষেও। এই সমাজ একদিনে নারীবিদ্বেষী, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিপন্থী। তাই, সব সময় শুধু মাঠের জয়পরাজয় দিয়ে ওদের শক্তিমত্তা আমি বিচার করি না। হারলেও ওরা একটা বড় গেইমে জয়ী হয়েই ওখানে গেছে, ওটাই বৃহত্তর গেইম।
কিন্তু মাঠের বাইরে ওদের অর্জন নেই, সেটা নারী বলেই। মাঠে ভিনদেশি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়লেও ওদের ব্যক্তিজীবনে, মানে মাঠের বাইরের সংগ্রামটা কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধেই। যে কারণে পুরুষ দলের খেলোয়াড়েরা মাঠের বাইরে স্টার হন, বড় ব্যবসায়ী হন, এমপি হন, কোম্পানির মালিক হন; ওরা কিছু হতে পারে না। আমরা হতে দিই না।
ভেবে দেখুন, আমাদের সমাজে ছেলেদের আগে মেয়েদের বিয়ের রীতি। কিন্তু খেলোয়াড় মেয়েদের বিয়ে/সংসার নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। পুরুষ ক্রিকেটে জাতীয় দলে চান্স পেয়েই ছেলেরা ‘উপযুক্ত’ পাত্রী দুমদাম বিয়ে সেরে নেন। মেয়েরা সেখানে অধিকাংশ আছেন খেলা নিয়েই।
বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী/শ্বশুরের পরিবার আর খেলতে না দেওয়ার শঙ্কা আছে। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজ বা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে তো আর শ্বশুরের পরিবার বলবে না, “বাবা তুমি বাড়ির জামাই হয়ে ড্যাং ড্যাং করে খেলতে গেলে আমরা সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে?”
সময় মতো বিয়ে না করারও আবার সমস্যা। আমাদের সমাজে পুরুষ মানুষ বিয়ে করার সময় পঞ্চাশোর্ধ্ব হলেও ১৬-২৫ বছরের বয়সী মেয়ে খোঁজেন। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বিয়ে করার সময়ও অল্পবয়সী পাত্রী চায়। অথচ এই অল্প বয়সী খেলোয়াড় মেয়েদের ক্যারিয়ার তখন তুঙ্গে থাকে। তাই এক্ষেত্রে অনেকে বাধ্য হয়ে বিয়ে না করার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেন।
ক্রিকেটার জাহানারা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে যে বিয়ে করবে সে এবং তার পরিবার ক্রিকেটটা কীভাবে নেবে এসব আমাকে চিন্তা করতে হয়। ক্রিকেট নিয়ে বাইরের ছোট্ট কোনো বাধাও আমি মেনে নিতে পারব না।’
ক্রিকেটার রুমানা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো শ্বশুর-শাশুড়ি বা হাজবেন্ড চায় না তার স্ত্রী বা ছেলের বউ খেলাধুলার সাথে জড়িত থাকুক। ক্রিকেটটা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কোনোকিছু মেলালে হবে না। এক্ষেত্রে হাজবেন্ড যদি বাধা দেয়, আমি মানতে পারব না।’
আজ একটা ম্যাচ জয়ের সূত্র ধরে এত কথা বলার কারণ মূলত একটাই, আমাদের দেশের মেয়েদের অর্জন যেন শুধু ট্রফি বা কাপ দিয়ে বিচার না করি। এটা এক ধরনের প্রতিবাদ। এটা অন্ধকারকে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিষেধক টিকা, সমন্বয়বাদী সমাজের সেইফগার্ড (ক্রিকেটের ভাষায় abdominal guard)।
তাই আমি বলি, আমাদের দেশে কখনো সুশাসনের বাইরে দুঃশাসন আসবে না, আলোর বিপরীতে অন্ধকার আসবে না, কোথাও না কোথাও আলো থাকবেই, যে আলোকে ধরে আমরা এগিয়ে যাবো। মূল কারণ হলো, আমাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি না, কারণ গার্মেন্টসকর্মী বোনরা, কর্মজীবী নারীরা, ঘর থেকে বের হওয়া নারী, খেলাধুলা করা মেয়েরা।
আমি তাই তাদের সব ধরনের জাতীয় পর্যায়ে এবং আমরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে উদযাপন করি। এটা শুধু ওদের বাহবা দিতে নয়, দেশে যারা নারীবিরোধী, নারীর অগ্রযাত্রা বিরোধী তাদের ধসিয়ে দিতেও।
মোজাফ্ফর হোসেন : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক