বিজ্ঞতার ভান, অজ্ঞতার দান
- মাহতাব উদ্দিন আহমেদ
- প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ০১:৪৪ PM , আপডেট: ২৮ মে ২০২৫, ০৭:২৫ PM
বাংলাদেশের প্রতিটি অফিসে এক বিশেষ প্রজাতির মানুষ থাকে—যারা কোয়ান্টাম ফিজিক্স থেকে শুরু করে কাবাবের রেসিপি পর্যন্ত সবই জানে। এমন আত্মবিশ্বাসে কথা বলে, গুগলও একসময় বলে, ‘ভাই, তুমি বলো, আমি দেখি।’
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গাটা হলো—Stav Atir, Emily Rosenzweig আর David Dunning নামের তিন গবেষক এক স্টাডিতে দেখিয়েছেন, যত বেশি আপনি ‘এক্সপার্ট’ হবেন, ততই আপনি এমন সব জিনিস জানেন বলে দাবি করবেন, যেগুলোর অস্তিত্বই নেই।
এই অসাধারণ রোগটার নাম: ‘আমি তো জানিই’ সিনড্রোম। ঢাকার কর্পোরেট বোর্ডরুমে একে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘ভাই, এই আইডিয়াটা তো আমার আগেই ছিল!’ Harvard Business Review–এ প্রকাশিত সেই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে কিছু আসল আর কিছু বানানো ধারণার সাথে পরিচিত কিনা জিজ্ঞেস করা হয়। মজা হলো, বিশেষজ্ঞরাই সবচেয়ে বেশি ফাঁদে পড়েছে, ‘Blockchain-Based Emotional Payroll Systems’ শুনেই বলে বসে, ‘হ্যাঁ, আমরা তো আগেই এটা ইমপ্লিমেন্ট করেছি!’
এদের কেউই পুরা মিথ্যা বলছে না। মূল সমস্যা হলো—পদবির চাপ। বাংলাদেশে কেউ একবার ‘স্যার’ বা ‘বস’ বললে আপনার দায়িত্ব হয়ে যায়, ক্লাউড কম্পিউটিং থেকে ক্যান্টিনের পোড়া পরোটা পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে হবে।
পদ যত উঁচু, ‘আমি জানি না’ বলার এলার্জিও তত তীব্র। একবার এক ক্লায়েন্ট কলে বসেছিলাম, দেশের এক নামী গ্রুপের CFO এত জোরে ‘AI orchestration’ আর ‘microservice cloud fabric’ বলছিলেন, মনে হচ্ছিল উনি NASA-তে ট্রেইনিং নিয়ে এসেছেন। পরে বুঝলাম, উনি সম্ভবত কোন সেমিনারের ফ্লায়ার থেকে শব্দগুলো মুখস্থ করে এসেছেন। কেউ কিছু বোঝেনি, কিন্তু সবাই মাথা নাড়ছিল, কারণ ‘স্যার’-এর মুখের বিরোধিতা মানে, বুফেতে বাসি কাচ্চি খাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া।
মিটিংয়ে কিছু না জানাটা অপরাধ। অজ্ঞতা স্বীকার? ক্যারিয়ার সুইসাইড। তাই এক্সপার্টরাও করে কী, মাথা নাড়ে, দুইটা ইংরেজি শব্দ ছুঁড়ে দেয়, আর প্রার্থনা করে যেন কেউ ফলোআপ না চায়। এটা একটা সারভাইভাল স্কিল। অনেক প্রতিষ্ঠানে যে বেশি স্মার্টভাবে বাজে কথা বলতে পারে, সেই হয় ডিরেক্টর। তার উপর যদি ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট আর পাওয়ারপয়েন্টে দুইটা ফ্লাইং অ্যানিমেশন থাকে, তাহলে তো সোজা ‘চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার’।
কিন্তু সমস্যাটা হইল, এই ভুয়া আত্মবিশ্বাস যখন বাস্তব সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে তখন? এই জন্যই আমাদের এয়ারপোর্টে লাগেজ হারায়, ব্রিজ বানাতে বাজেট তিনগুণ লাগে। কারণ কেউ হয়তো ‘রিস্ক-বেইজড ফাইনান্সিয়াল মডেলিং’ শুনে ভেবেছে এটা নেটফ্লিক্সের সিরিজ! মেডিক্যালে ওভারক্লেইমিং মারে। ফাইন্যান্সে দেউলিয়া করে। পলিসিতে প্রজন্ম ধ্বংস। আর স্টার্টআপে? এ কারণেই তো বৃষ্টি পড়লেই আপনার ডেলিভারি অ্যাপ ক্র্যাশ করে।
আমাদের কর্পোরেট জগৎ আত্মবিশ্বাসকে পুরস্কৃত করে, সততাকে না। কিন্তু এইটা বদলাতে হবে। একজন ভালো নেতা সব কিছু জানেন না—এইটা স্বীকার করাটাই প্রকৃত নেতৃত্বের সূচনা। সত্যিকারের এক্সপার্ট হলো সেই, যে জানে তার সীমা কোথায়। যে প্রশ্ন করে, উত্তর বানায় না। যে বাহবা নয়, সত্যকে বেছে নেয়।
আমাদের দরকার বোর্ডরুমে অহংকার নয়, কৌতূহল। দরকার এমন বস, যে বলে ‘ভালো প্রশ্ন করেছো, চল একসাথে দেখি।’ দরকার এমন নেতা, যে বলে ‘আমি জানি না, কিন্তু যিনি জানেন তাকে ডাকি।’ কারণ, আপনি কিছু না জেনে জানেন বলে ভাব দেখালে আপনি স্মার্ট হন না—আপনি হানিকারক হয়ে ওঠেন।
এত সব আসল সমস্যার দেশে, আরেকটা ভুয়া জানাশোনা আমাদের দরকার নেই। তাই যখন কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করে—’AI-driven ESG-integrated 6G compliance frameworks’ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা, তখন হেসে বলুন—‘না ভাই, কিছু জানি না। একটু খুলে বলবেন?’ এইখান থেকেই শুরু হয় আসল নেতৃত্ব।
লেখক: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, রবি।