বাংলাদেশ ইস্যুতে অমর্ত্য সেন চিন্তিত, তবু আশায় বসতি
- রাজু নূরুল
- প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ০৬:৫৫ PM , আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫, ০৬:৫৫ PM

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যম পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরের শান্তিনিকেতনের নিজ বাসায় বসে যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে তাঁর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অমর্ত্য সেন তার সরল ভাষায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বলেছেন, “আমি চিন্তিত যে, বাংলাদেশ এই জটিল পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করবে।” যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ড. সেনের বক্তব্য খণ্ডিতভাবে আসছে, এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামির আমির ড. সেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তাহলে চলুন দেখা যাক, এই বিশিষ্ট চিন্তক বাংলাদেশকে নিয়ে কি ভাবছেন।
অমর্ত্য সেনের জন্ম ও পারিবারিক সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ তাঁর জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ফলে এখানে ঘটে যাওয়া নানা কিছু তাঁকে গভীরভাবে আক্রান্ত করে। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “আমি আমার ছোটবেলার অনেক দিন ঢাকায় কাটিয়েছি, ওখানকার স্কুলে পড়েছি, এবং মানিকগঞ্জের দাদার বাড়িতে ঘুরে বেড়াতাম, তাই বাংলাদেশের বর্তমান বিপত্তি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তাই অন্য অনেকের মত আমিও বাংলাদেশ কীভাবে সাম্প্রতিক সম্মুখীন হওয়া বিপত্তি কাটিয়ে সেটা নিয়ে চিন্তিত!”
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের উন্নতি যে হয়েছে, তার শংসা করেছেন অমর্ত্য সেন। মাথাপিছু আয় বাড়ার ক্ষেত্রে যে বাংলাদেশ এক পর্যায়ে ভারতকেও অতিক্রম করেছিল, সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এসব অগ্রগতির পেছনে এনজিওদের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, মানব উন্নয়নের নানা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ যে বিগত বছরগুলোতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, এ নিয়ে লিখেছিলেন অমর্ত্য সেন; বিশেষ করে ভারতের সাথে তুলনামূলক অগ্রগতি চিত্র তুলে ধরায় ভারত সরকারের তোপের মুখেও পড়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে তিনি তুলনামূলকভাবে স্বাধীন মনে করেন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পরও বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে।” অনেক দেশের মতো, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন ক্ষমতার দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দেয় না, তার প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশের এত সব অর্জন স্বত্বেও, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি জোর দিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগকে যেন নির্বাচনের বাইরে না রাখা হয়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, কাউকে পাশ কাটিয়ে যে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে একই ধরনের ভুল, যা বিগত সরকারগুলো করেছে। সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অগ্রগতি সম্ভব হবে, এবং তিনি আশাবাদী যে, আগামী নির্বাচন পূর্বের তুলনায় নিরপেক্ষ হবে। এ পর্যায়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ নিয়ে আমি চিন্তিত, তবে আশা ছাড়িনি।”
এ সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সম্ভবত ড. ইউনূসের নেতৃত্ব নিয়ে। ইউনূস দেশকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছেন, এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা চালু আছে, আছে চায়ের টেবিলে ঝড়। ইউনূসকে তার পুরোনো বন্ধু উল্লেখ করে ড. সেন বলেছেন, “ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রতি ইউনূসের আন্তরিকতা আছে। তিনি মানুষ হিসেবেও ভাল। কিন্তু কেউ হুট করে সরকার প্রধান হয়ে গেলে তাকে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু নানা রকম বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়।”
ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান করেছে এবং যারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়, তাঁদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। তবে, বর্তমানে সংখ্যালঘু বিষয়ক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেন, “ভারতে মসজিদ কিংবা বাংলাদেশে মন্দির—কোনোটা ভাঙা কাম্য নয়। ধর্ম দেখে দেখে নিজের সুবিধামতো ঘটনার নিন্দা জানালে তা ভালো নয়; এমনকি দাঙ্গাও ছড়িয়ে পড়তে পারে।” তিনি সতর্ক করেছেন, ১৯৪০-এর দশকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূচনা এই রকম ঘটেছিল।
এই ছিল মোটা দাগে অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের সারাংশ। ৯১ বছর বয়সী ড. সেন বাংলাদেশ বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন। উনি রাজনীতিবিদ নন যে, কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা পরিস্থিতির ভিত্তিতে পক্ষপাতদুষ্টভাবে নিন্দা বা প্রশংসা করবেন, এটি তাঁর স্বভাবের অংশও নয়। তবে, যে-সব বিষয় তিনি উত্থাপন করেছেন–যেমন বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, এবং সেই সাথে দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর গভীর উদ্বেগ – তা নিয়ে তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ রয়েছে।
তাঁর মন্তব্যগুলোতে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং দেশের প্রতি আন্তরিক আবেগের ছোঁয়া পড়ে। তবে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যেকোনও বিদেশি মাধ্যমে প্রকাশিত খবর প্রায়ই এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে, মূল বার্তাটি স্পষ্টভাবে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিটি মাধ্যম তাঁদের সুবিধামতো সাক্ষাৎকারের অংশগুলো উদ্ধৃত করে বা ফটোকার্ড বানিয়ে প্রচার করে, যার ফলে মূল বক্তব্য থেকে বিচ্যুতি ঘটতে থাকে।
বাংলাদেশ বিষয়ক নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত ড. সেনের উদ্বেগকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা এবং সেই আলোকে দেশের সমস্যাগুলোতে বাস্তবসম্মত সমাধানের পথ খোঁজা।
লেখক: লেখক, অনুবাদক, গবেষক
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com