সরকারের লক্ষ্যহীন যাত্রার ইতি টানতে হবে

সাইদুর রহমান
সাইদুর রহমান  © টিডিসি

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফ্যাসিবাদ শাসনের অবসানের পর সবার মধ্যে ঐক্যের ফাটল ধরেছে। শুরুতে যে অসাধারণ ঐক্য ছিল, সেটি ধীরে ধীরে ফিকে যাচ্ছে। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এভাবে তৈরি হওয়া অনৈক্য ভালো কিছু বয়ে আনে না।

সরকারের লক্ষ্যহীন যাত্রায় হতাশাগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। সরকার পতন আন্দোলনে ছাত্রদের মূল প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার আবেদন হারিয়ে ফেলছে। এ পরিস্থিতি সরকারের উচিত কী করা আর কী না করা। জানতে হবে কোথায় থামতে হবে, আবার কোথা থেকে শুরু করতে হবে।

সরকারের সঙ্গে নানা স্টেকহোল্ডারদের সম্পর্কের টানাপোড়েন গণঅভ্যুত্থানের প্রভাব কমতে শুরু করেছে। এ সুযোগে ফ্যাসিবাদও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে। এরই অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ ১২ নভেম্বর ঢাকা শহরের কয়েক জায়গায় সিরিজ বোমা নিক্ষেপের মতো গুপ্ত মিছিল করেছে। সরকারের ভিতরে ঝাঁকুনি দেওয়া শুরু করেছে।

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন: ভারতীয় উপমহাদেশে সম্ভাব্য প্রভাব

নানা কারণে সৃষ্ট সংকট সমাধানের একমাত্র পথ গণতান্ত্রি পথে অগ্রযাত্রা। সবাইকে একটি প্ল্যাটফর্মে রেখে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ানো। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত তিন মাসে ওনার প্রতিটি বক্তব্যে বারবার উল্লেখ করেছেন, ‘এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না, এই সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। বাংলাদেশের সবা পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না।’

দেশের সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখার দায়িত্ব সরকারের। ঐক্যের ক্ষেত্রে সরকারের ভেতরেও আন্তরিকতার কিছুটা ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে। সরকার যা কিছু করবে, তা ঐক্যবদ্ধ শক্তির পরামর্শেই করা উচিত। সর্বশেষ বিতর্কিত দুজন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা বানানো হলো, এ নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে গেছে। অথচ সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলোও জানে না।

আরও পড়ুন: তারেক রহমানের শিক্ষা সংস্কার ভাবনা

ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সব পন্থায় অবলম্বন করে। সেই পন্থাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া বা ফ্যাসিবাদমুক্ত করবার ক্ষেত্রে সরকার অনেকটা ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করে। এই ধীরে চলো নীতি ফ্যাসিবাদকে ‘অতিবিপ্লবী’ বানিয়ে সরকারের সহযোগী হতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন জায়গায় যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের অনেকের অতীত কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে জনগণের তেমন সম্পৃক্ততা নেই। জনভিত্তি যাদের নেই, তাদের সরকারে রেখে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।

নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনে সরকারের গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান সবার আগে পুনর্গঠন করা উচিত ছিল। নির্বাচনের রোডম্যাপ সাধারণত নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো দেশে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার আরেকটি কারণও থাকতে পারে, সেটি হলো সরকারের সুর্নিদিষ্ট মেয়াদ নেই। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের উচিত হবে দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এই নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করলে বরং রাজনৈতিক দলগুলো কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে পারবে।

আরও পড়ুন: তরুণ প্রজন্ম ও ৭ নভেম্বরের বিপ্লব

অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন দেশ শাসন করলে জনঅনাস্থা তৈরি হয়। সেই অনাস্থার পথে সরকার। সরকারের লক্ষ্যহীন যাত্রার ইতি টানতে হবে। ইতিমধ্যে সরকারের দুজন উপদেষ্টা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। একজনকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আরেকজনকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে উত্তরণের একটাই পথ নির্বাচন। দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে দরকার দক্ষ লোকের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করা। সেটি চলতি মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের শুরুতেই নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে ঘোষিত রোডম্যাপ থেকে সর্বোচ্চ ছয়-সাত মাসের মধ্যে দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। এ মুহূর্তের সরকারের ওপর জনআস্থা তৈরির জন্য এর মতো ভালো কোনো মাধ্যম আছে বলে আমার মনে হয় না। মনে রাখতে হবে, সরকার লক্ষ্যহীন হলে রাজনীতিবিদরা ঐক্যবদ্ধ হবে। সরকারের লক্ষ্যহীন প্রক্রিয়া ঠেকাতে এই ঐক্যবদ্ধতার সময় কে ফ্যাসিবাদ আর ফ্যাসিবাদ নয়, সেটি বিবেচ্য থাকে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর মতে, রাজনীতিবিদরা হাত মেলাচ্ছে, আর বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়ি এগিয়ে আসছে। 

লেখক : রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশনবিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক


সর্বশেষ সংবাদ