জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় করার সময় এখন

আমিন মিয়া, সহকারি অধ্যাপক, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
আমিন মিয়া, সহকারি অধ্যাপক, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর  গ্রাজুয়েটদের মান এবং অধিভুক্ত কলেজগুলোর যথাযথ অ্যাকাডেমিক মনিটরিং নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা রয়েছে। নবনিযুক্ত উপাচার্য মহোদয় শিক্ষার্থীদের কোন মানের সনদ দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। নানাবিধ সমালোচনার প্রধান কারণই হল, গত ৩২ বছর যাবৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা না করে উচ্চতর শিক্ষা বোর্ড হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:

বোর্ড হিসেবে সফলতা:

১। প্রতিবছর ৪/৫ লাখ শিক্ষার্থীর অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করা।

২। পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের কাজ দক্ষতার সাথে করা  এবং সকল ফলাফল অনলাইনে দেখার সুযোগ।

৩। নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে অনার্স মাস্টার্স চালু এবং  প্রতিটি বিষয়ে ২০০-৩০০ আসন বরাদ্দ দিয়ে, অধিভুক্ত কলেজ ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়িয়ে এটিকে একটি অর্থ উপার্জনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।

৪। কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার আগ্রহ কম হলেও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তিতে আগ্রহের ঘাটতি নেই।

৫। দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি বাতিল করে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মতো প্রধান পরীক্ষক পদ্ধতি চালু করা, যা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।

৬। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ এর ১ম সংবিধি লঙ্ঘন করে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রণীত সংবিধি অনুযায়ী  অধিভুক্ত কলেজসমূহের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।।যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন

৭। অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি, আর্থিক সুবিধা ভোগের সকল কর্মসূচি ও অবকাঠামো নির্মাণে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না।

৮। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি উচ্চশিক্ষা বোর্ড হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। উচ্চশিক্ষাকে বোর্ডের আদলে পরিচালনা করার নজির শুধমাত্র বাংলাদেশেই আছে।

৯। আইনে ২টি পরিচালক পদ থাকলেও, প্রশাসনিক কাজের জন্য ১৮টি পরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে ।

১০। বোর্ড হিসেবে আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং প্রশাসনিক অবকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যা করতে পারেনি:

১। মেধা যাচাই না করে গণহারে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা।

২। কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অবকাঠামো না থাকার পরেও অনার্স ও মাস্টার্স এর অনুমোদন দেওয়া এবং এসব প্রোগ্রামের  নিয়মিত ক্লাস না হওয়া।

৩। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, রি-স্ক্রুটিনি ও ভাইভা পরীক্ষা মান নিশ্চিত করতে না পারা।

৪। পরীক্ষা কমিটি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা নেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সকল বিষয়ের পরীক্ষা কমিটি গঠনের উদাহরণ কেবল মাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে।  

৫। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ১৯৯২ এর ১ম সংবিধির ৭(২), ৭(৩), ৭(৪), ৭(৬), ৮(২), ৮(৩), ৮(৪), ৮(৬), ৯(২), ৯(৩), ৯(৪), এবং ৯(৬) ধারা অনুযায়ী বিগত ০৫-১১-২০০৭  তারিখে অনুষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ৬৩তম সভার এবং গত ০৩-১২-২০০৭ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৯৯তম সভার সিদ্ধান্তের আলোকে বোর্ড অব স্টাডিজ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরস গঠন করা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে কার্যকর রাখা হয়নি। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষা, অ্যাকাডেমিক মনিটরিং ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের মান উন্নয়নে এই বোর্ডগুলোই যাবতীয় সুপারিশ প্রদান করার কথা। অথচ গত ৩২ বছর যাবত এগুলোকে অকার্যকর রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে গুণগত উচ্চশিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ ও সমালোচিত করা হচ্ছে। 

৬। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষা, অ্যাকাডেমিক মনিটরিং ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রোমোশন, অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম চালু, নতুন অ্যাকাডেমিক ইউনিট গঠন, ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ, বোর্ড অব স্টাডিজ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরস কার্যকর করতে প্রত্যেক উপাচার্য মহোদয়কেই বাধা দেওয়া হয়েছে এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে, যা বতর্মানেও চলমান।
উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে ৫টি অ্যাকাডেমিক গ্রুপকে ৫টি স্কুল/ফ্যাকাল্টি করার প্রস্তাবনা এবং বোর্ড অব স্টাডিজ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরস পুনর্গঠন করে কার্যকর করতে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার কোন অগ্রগতি হয়নি।

৭। প্রায় ২২৫০ টি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বিপুল সংখ্যক কলেজের অ্যাকাডেমিক মনিটরিং, সিলেবাস, কারিকুলাম, ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের মান উন্নতিকরণে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ শিক্ষক ও মডেল অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম থাকার দরকার ছিল তা গত ৩২ বছরেও এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ৩২ বছর বয়সী একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৬ জন অধ্যাপকসহ ৭৪ জন শিক্ষক রয়েছে। উল্লেখ্য, দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাকে গণমুখীকরণের উদ্দেশ্যে একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনার্স, মাস্টার্স এবং অন্যান্য অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ১৫০ জন, এর মধ্যে অধ্যাপক ৩০ জন।

৮। আইনে প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ টি অ্যাকাডেমিক ইউনিট এর উল্লেখ থাকলেও, আইনের ৬(ড) ধারার আলোকে রেগুলেশন করে শিক্ষা ও গবেষণার স্বার্থে নতুন অ্যাকাডেমিক ইউনিট (স্কুল অব আর্টস, স্কুল অব ‘ল’ ইত্যাদি অথবা একই নামে ফ্যাকাল্টি) চালু করতে পারবে। বোর্ডের পরিচালক পদ বাড়াতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অ্যাকাডেমিক ইউনিট বাড়াতে পারে নাই। 

৯। আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী দেশের যেকোনো স্থানে ক্যাম্পাস স্থাপন করার সুযোগ থাকলেও, ৩২ বছর বয়সী একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথচ নিজস্ব অ্যাকাডেমিক ক্যাম্পাস করতে পারেনি, ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত  করতে পারেনি। অথচ, একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তার রয়েছে উপাচার্যের বাসভবনসহ নিজস্ব দৃষ্টিনন্দন অ্যাকাডেমিক ক্যাম্পাস। উল্লেখ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার প্রথম তথা অন্যতম প্রধান সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এটিকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজ্য গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় মনে করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে লাহোর থেকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত একটি বিশাল অঞ্চল এর অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলের ১৫১টি স্নাতক কলেজ ও ১৬টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। কলকাতা শহর ও শহরতলিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি ক্যাম্পাস/শিক্ষাপ্রাঙ্গণ (কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস, রাজাবাজার ক্যাম্পাস, শহিদ ক্ষুদিরাম শিক্ষা প্রাঙ্গণ ইত্যাদি) এবং ৭টি ফ্যাকাল্টি রয়েছে। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৪র্থ।

১০। শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে মানসম্মত গবেষণা কর্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের গবেষণা ভাতা ও পুরস্কার প্রদানের সুযোগ অপ্রতুল। গবেষণা বিমুখ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতি বছর গবেষণায় বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগই অব্যয়িত থাকে।

পরিশেষে বলব, বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিকভাবে পরিচালিত না হয়ে শিক্ষা বোর্ডের মতো পরিচালিত হলে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কখনই উচ্চশিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। মূল উপাদানকে অগ্রাহ্য করে, গত ৩২ বছরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।

লেখক: আমিন মিয়া, সহকারি অধ্যাপক, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence