‘ভাই পানি লাগবে কারও, পানি’: এক অসমাপ্ত গল্পের শেষ আর্তি
- ড. মো. মোর্ত্তূজা আহমেদ
- প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:১০ PM , আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:১৫ PM
‘ভাই পানি লাগবে কারও, পানি’—এই বাক্যটি কোনো সাধারণ আহ্বান ছিল না। এটি ছিল একটি আন্দোলনের হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত, যা আজও আমাদের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। এই বাক্যটি মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের এক অনন্য চিৎকার, যা তার মানবিকতা, দায়িত্ববোধ, এবং সাহসিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ হয়ে রয়ে গেছে। যখন একটি জাতি সংগ্রামের পথে এগিয়ে যায়, তখন কিছু মুহূর্ত থাকে যা আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে যায়, এবং মুগ্ধর এই শেষ আহ্বান তেমনই একটি মুহূর্ত।
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ও আদর্শিক ছাত্র, যিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে তিনি তার সতীর্থদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদেরকে সঙ্গ দিয়েছিলেন, এবং তাদের সুরক্ষার জন্য কাজ করেছিলেন। কিন্তু তার মানবিকতা শুধু এখানে সীমাবদ্ধ ছিল না; তার মধ্যে যে গভীর দায়িত্ববোধ ছিল, তা ছিল অসাধারণ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়, মুগ্ধ দেখেছিলেন তার সহপাঠীরা তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছে, আন্দোলনের উত্তাপে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সেই মুহূর্তে, তিনি নিজেকে তাদের সেবায় নিয়োজিত করলেন, তাদের জন্য খাবার পানি বিতরণের দায়িত্ব নিলেন। মুগ্ধের এই কাজ ছিল তার নিঃস্বার্থতার প্রতীক, যেখানে নিজের শারীরিক নিরাপত্তার চেয়ে অন্যদের প্রয়োজনকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
‘ভাই পানি লাগবে কারও, পানি’—এই আহ্বানটি ছিল তার নিঃস্বার্থতার চূড়ান্ত উদাহরণ। এটি ছিল একটি আর্তি, যেখানে একটি জীবনের শেষ মুহূর্তের চেতনাও অন্যের কল্যাণের জন্য নিবেদিত ছিল। মুগ্ধের এই শেষ কথাটি আজও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়—কীভাবে একজন যুবক এমন গভীর দায়িত্ববোধের সাথে তার শেষ মুহূর্তেও অন্যের কথা চিন্তা করতে পারে? তার এই চিৎকার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবতার প্রকৃত শক্তি কোথায় নিহিত।
এই বাক্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা কাহিনিটি শুধু একটি ব্যক্তির নয়, এটি একটি জাতির জন্য দৃষ্টান্ত। মুগ্ধ ছিলেন সেই সংগ্রামী ছাত্র, যিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্তে নিজের জীবন নিয়ে ভাবেননি, বরং অন্যদের সাহায্য করার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই আত্মত্যাগ এবং মানবিকতা আজও আমাদের জাতির মধ্যে মুগ্ধর স্মৃতিকে অমর করে রেখেছে। "ভাই পানি লাগবে কারও, পানি"—এই চিরস্মরণীয় বাক্যটি আমাদের শেখায়, কীভাবে নিজের চেয়ে অন্যের কল্যাণের কথা ভাবা যায়, এবং কীভাবে মানবতার চূড়ান্ত আদর্শে জীবন উৎসর্গ করা যায়।
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র এবং সামাজিক সচেতন ব্যক্তি। তার শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিভাবান ও দায়িত্বশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি, মুগ্ধ আন্দোলন ও সমাজসেবার কাজে সক্রিয় ছিলেন। তার সহপাঠীদের তথ্য মতে মুগ্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সক্রিয়। তার আদর্শিক নেতৃত্ব এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ তাকে ছাত্রদের মধ্যে একটি উজ্জ্বল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তিনি শুধু পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না, বরং দেশের ভবিষ্যতের জন্য তার দায়বদ্ধতা ছিল গভীর।
মুগ্ধের জীবনে স্বপ্নের কোনো সীমা ছিল না। মোটরসাইকেলে করে ইউরোপ ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ইতালিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম ফাইভারে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং করে অর্থ সঞ্চয় করছিলেন। কিন্তু, এই স্বপ্নগুলো তার সাথে অপূর্ণই থেকে গেল। মুগ্ধের সেই উচ্ছ্বাস, সেই প্রাণবন্ততা আজও আমাদের মনে কষ্টের সুর তুলে ধরে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে মীর মুগ্ধ ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা এবং চাকরি ক্ষেত্রে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে। মুগ্ধ নিজেকে পুরোপুরি আন্দোলনের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। মুগ্ধ যখন আন্দোলনের মাঠে খাবার পানি বিতরণ করছিলেন, তখন পুলিশি সংঘর্ষের মধ্যে তার মাথায় গুলি লেগে যায়। সেই মুহূর্তে, মুগ্ধ জীবনের শেষ মুহূর্তে নিজের চির পরিচিত সহানুভূতি ও মানবিকতার প্রদর্শন করেন। "ভাই পানি লাগবে কারও, পানি"—এই বাক্যটি ছিল তার চূড়ান্ত আর্তি, যা তার আত্মত্যাগ এবং মানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ। তার মৃত্যু আন্দোলনকারীদের মধ্যে গভীর শোকের স্রোত বয়ে এনেছিল, যা জাতির মনকে নাড়া দিয়েছিল।
মীর মুগ্ধের মৃত্যু বাংলাদেশের জাতির কাছে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। তার আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতা দেশে একটি নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জাতীয় পর্যায়ে তার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া ছিল ব্যাপক, এবং সামাজিক বিভিন্ন স্তরে এটি গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার স্মরণে গড়ে ওঠা উদ্যোগ এবং কর্মসূচিগুলো মুগ্ধর আদর্শকে সম্মান জানিয়েছে এবং তার মৃত্যু আন্দোলনকারীদের মধ্যে শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয় তোরণের নামকরণ “শহীদ মীর মুগ্ধ” তার অবদানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। মুগ্ধের মৃত্যু একটি প্রজন্মের আত্মত্যাগের চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তার সাহসিকতা এবং মানবিকতা শুধুমাত্র একটি আন্দোলনের ইতিহাসই নয়, বরং একটি অনুপ্রেরণার গল্প। তার জীবন ও আত্মত্যাগ আজও আমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যা নতুন প্রজন্মকে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, এবং সাহসিকতার পথে পরিচালিত করে।
‘ভাই পানি লাগবে কারও, পানি’—এই বাক্যটি মীর মুগ্ধের মানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ। তার জীবন এবং মৃত্যু আমাদের শেখায় কীভাবে একজন মানুষ নিজের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অন্যদের জন্য আলোকিত হতে পারে। মুগ্ধের অসমাপ্ত গল্পের মধ্যে একটি পূর্ণতা রয়েছে, যা আমাদেরকে তার আদর্শের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। তার স্মৃতি আমাদের মাঝে চিরকাল অমলিন থাকবে, একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে, যা আমাদের সমস্ত সময় পথ দেখাবে।
এই আন্দোলন শুধু মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের সাহসিকতার গল্প নয়, এটি আবু সাঈদ, ফারহান ফাইয়াজ, ইয়ামিন, তাহমিদ তামিমসহ নাম না জানা অগণিত সাহসী মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা এবং অবদানের গল্পও। তাদের ত্যাগ এবং সাহসিকতাই এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে এবং জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তৈরি করেছে।
তারা প্রত্যেকেই নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, এবং স্বপ্নকে পেছনে ফেলে দেশের জন্য, সমাজের জন্য এবং সবার অধিকার রক্ষার জন্য একত্রিত হয়েছিল। তাদের এই নিঃস্বার্থ সংগ্রাম আমাদেরকে শেখায়, কীভাবে একটি জাতি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে পারে। মুগ্ধর মতো, তারা সবাই আমাদের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবেন—একটি ন্যায়বিচারের আদর্শ এবং মানবতার প্রতীক হিসেবে।
এই আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ব্যথা এবং প্রতিটি চিৎকার আমাদের শিখিয়েছে যে, আমাদের দেশকে গড়তে কেবল একজন নয়, বরং অনেকের অবদান থাকে। আবু সাঈদ, ফারহান ফাইয়াজ, ইয়ামিন, তাহমিদ তামিম এবং নাম না জানা সকলের আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে কেবল কথা নয়, কাজও প্রয়োজন। তাদের এই অবদান কখনোই ভোলার নয়, বরং এটি আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে, আরও উন্নত, আরও মানবিক একটি দেশ গড়তে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।