একজন শিক্ষক বলছি
- মো. আবদুল হাকিম
- প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ১০:০০ AM
এ যুগের শিক্ষকরা কি মহান পেশার প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করছেন? যদি তা না হয়, তাহলে সমাজ কীভাবে তাদের আদর্শের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করবেন। লিখেছেন- মো. আবদুল হাকিম
মহান, সম্মানজনক ও আদর্শ পেশার নাম শিক্ষকতা। একজন শিক্ষক প্রতিনিয়ত অকৃপণভাবে শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকেন। তিনি সমাজ সংস্কার, অশিক্ষার প্রভাব দূরীকরণ ও জনসচেতনতা ইত্যাকার বহুবিধ ক্ষেত্রে কল্যাণমুখী কাজ করে থাকেন। মানুষের বিপদে, অসহায়ত্বের পরামর্শ, দিকনির্দেশনা, সহযোগিতা, সহমর্মিতায় এগিয়ে আসেন সর্বাগ্রে। কিন্তু আজকের দিনে শিক্ষকদের সেসব ভূমিকা কেন জানি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। সবাই ব্যক্তিস্বার্থের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছেন।
একজন শিক্ষককে প্রথমে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু ভালো পড়ালেই ভালো শিক্ষক বলা যাবে না। তাকে নৈতিকভাবে উন্নত হতে হবে। তার মাঝে আদর্শ ও মূল্যবোধ থাকতে হবে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাকে সম্মান করবে এবং চিরকাল সেই আদর্শকে অনুসরণ করবে। কেননা, একজন ভালো শিক্ষকই দিতে পারেন ভালো শিক্ষা। হয়তো একারণেই শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। আর একজন শিক্ষকের আদর্শ শিক্ষার্থীর জীবনে নানাভাবে আলোড়ন ঘটায়।
আমি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমার একটা জীবন কেটেছে শিক্ষকতা পেশায়। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখার শিক্ষক ছিলাম। পেশাগত জীবনে সততা, ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে কোনো আপস করিনি। আমাদের সময়ে সব শিক্ষকরা এমনই ছিলেন; যাদের কাছে শিক্ষকতা মহান আদর্শিক পেশার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। একজন দায়িত্ব সচেতন শিক্ষকের কি যে সম্মান- আমি এখনো তা অনুভব করি। গর্ববোধ করি, এই মহান পেশায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আমার শিক্ষকতা জীবনে কিছু বিষয় আমি কঠোরভাবে অনুশীলন করেছি। প্রথমত. সৎ ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করা, দ্বিতীয়ত. পেশাগত দায়িত্বের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা, তৃতীয়ত. শিক্ষার্থীদের আদর্শের জীবন অনুসরণের শিক্ষা দেওয়া, চতুর্থত. লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকা এবং পঞ্চমত. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দেখা।
আমার শিক্ষকতা জীবনের সার্থকতা আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে আমার স্নেহের শিক্ষার্থীরা। আমি তাদের নিয়ে খুব গর্ববোধ করি। আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি, সচিব, টিএনও, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সরকারের বিভিন্ন স্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। এইসব প্রতিষ্ঠিত নাগরিকরা নিজেদের অবস্থান থেকে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে? এই গর্ববোধের আত্মতৃপ্তি আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
ভুলে গেলে চলবে না, সমাজে শিক্ষকের মর্যাদার আসনটি মহান শিক্ষকরাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তারা নিরলস শ্রম দিয়ে জ্ঞান বিতরণ করে গেছেন। আমার শিক্ষকতা জীবনে আমি শিক্ষার্থীদের শেখানোর প্রতি দায়বদ্ধতা পরিপালনে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছি। আজ অবসর গ্রহণের প্রায় এক যুগ অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। এখনো আমার ছাত্ররা আমাকে ফোন করে খবর নেয়। আমি ধন্য তাদের জন্য। আমার ছাত্ররা রাষ্ট্রের চালিকাশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা সুনাম ও সম্মানের সঙ্গে দেশের উন্নয়নে, এলাকার উন্নয়নে অনবদ্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে- এমনটি ভাবতেই নিজেকে ধন্য মনে হয়। সার্থক আমার শিক্ষকতা জীবন।
সমাজ সংস্কার ও জাতি গঠন, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে একজন আদর্শ শিক্ষকের অবদান কোনো রাষ্ট্রনায়ক, অর্থনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধির চেয়ে কম নয়। সঙ্গত কারণেই শিক্ষকের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসুরূপে গড়ে তোলাই হবে শিক্ষকদের দায়িত্ব। শিক্ষক এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবেন, যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষকের (প্রাইভেট টিউটর) প্রয়োজন না হয়। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো দেশের প্রধান প্রোডাকটিভ খাত। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধার লালন কেন্দ্র। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের লালন-পালনের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে দেশের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন সুনাগরিক তৈরি করা দেশের শিক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য।
কথা হচ্ছে এ যুগের শিক্ষকরা কি মহান পেশার প্রতি সেই দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করছেন? যদি তা না হয়, তাহলে সমাজ কীভাবে তাদের আদর্শের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করবেন- সেটাও তো দেখার বিষয়। শিক্ষকের জ্ঞান আহরণের বা জানার আগ্রহ থাকা উচিত। তিনি যে যে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ান, সেসব বিষয়ে আরো কম সময়ে আরো সহজ উপায়ে কী করে আরো ভালো শেখানো যায়, এমন পদ্ধতি খুঁজে বের করা উচিত। সময় নিয়ন্ত্রণ বা সময় সচেতনতা শিক্ষকতা পেশার একটি বড় গুণ। সময়ের সদ্ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষককে যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা সময়ানুবর্তিতা শিখবে শিক্ষকের কাছে। শিক্ষাবিদ দার্শনিক ও গণিতবিদ আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটেড বলেছেন, জীবন মূলত নানা পর্যায়ের অধীন। কাজের পর খেলা, পরিশ্রমের পর বিশ্রাম, দিনের ক্লান্তির পর রাতের নিদ্রা দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তেমনি শিক্ষাবর্ষে পঠন, পর্যালোচনা, পরীক্ষার অবকাশ ও নতুন পাঠারাম্ভের গতি আছে। মানবিক বৃত্তি-প্রবৃত্তি এবং কল্পনা-চিন্তারও সুন্দর মিল আছে। যারা শিক্ষক এবং যারা শিক্ষক হতে চান, সবার কাছে আহ্বান শিক্ষকতা অবশ্যই একটি পেশা তবে এর মূল লক্ষ্য জ্ঞানসেবা প্রদান বা জ্ঞান বিতরণ করা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোনা