বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রেজেন্টেশন যেন এক উৎসবের নাম
- শেখ সায়মন পারভেজ
- প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৪, ০২:২০ PM , আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ০২:২৯ PM
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নানা স্মৃতির চাদরে মোড়ানো। সেই চাদরের আলোতে স্পর্শ ব্যস্ত জীবনের এক ফাঁকে জাগিয়ে তুলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির কবিতাকে। তবে এমন অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি আমার। কেননা এখনো আমি অধ্যয়নত শিক্ষার্থী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেজেন্টেশনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা যেন চর্যাপদের পদকর্তা লুইপার মতোই আমার বাসনা।
আবার পাঠকও লেখাটি পড়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত জীবনে হয়ত ফিরে যাবে। এটাই আমার সার্থকতা। এতে আমার উপমা সংযোজন হয়ত পাঠকের কাছে খনার বচনের মতো আংশিক দুর্বোধ্য ঠেকবে। আবার কেউ কেউ সাক্ষী গোপালও হবে।
এইতো সেদিন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রেজেন্টেশন নির্ধারণ হলো। কেন জানি আমাদের প্রেজেন্টেশনের প্রতি একটা ভয় কাজ করে। সবার সামনে গিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। তাও আবার ইংরেজিতে। পিছনে থেকে কিছু বন্ধু ইংরেজি ব্যাকরণের ভুল শুনে মৃদু ভূমিকম্পের ন্যায় হাসবে। প্রেজেন্টেশনে কি হবে, না হবে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ক্লাসের সবাই একসাথে ফরমাল পোশাক পরিধান করবো। প্রেজেন্টেশনের আগের দিন যেন ব্যস্ততার অন্ত নেই।
আতাউর স্যার আমাদের প্রেজেন্টেশন নিবেন। নতুন যোগদান করেছেন আমাদের বিভাগে। আপাদমস্তক তারুণ্যের দীপ্তি। খুব সুন্দর করে ক্লাসে বুঝিয়ে দিলেন প্রেজেন্টেশনের কোনটিতে কত নম্বর। যেমন পোশাক পরিচ্ছদ, আলোচ্য বিষয়, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ইত্যাদি। খুব নিখুঁতভাবে আমাদের ধারণা দিলেন কীভাবে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। যেমন- স্যার বললেন, "শোনো , বিশেষ করে ছেলেরা, আমি কিন্তু তোমাদের আপাদমস্তক লক্ষ করব, এমন যেন না হয় জুতায় আঙ্গুলে সামনের ফাঁকা জায়গায় ধুলার আস্তরণ পড়ে আছে।"
এসব শুনে তো বাড়তি সতর্কতা অবস্থানে আমরা ছেলেরা। তাই প্রেজেন্টেশন উপলক্ষ্যে কেউ চুল পরিপাটি করছে। কেউ দাড়ি সেভ করছে। কেউ আগে থেকেই আরেক সিনিয়র ভাইয়ের কাছ থেকে জুতা বা প্যান্ট কিংবা শার্ট বা টাই জোগাড় করে রাখছে। আমি আবার আমার পোশাক ইস্ত্রি করলাম হাসানের ইস্ত্রি মেশিন দিয়ে। ইস্ত্রি করতে আমি তেমন পটু না, তাই হাসানকে দিয়েই ইস্ত্রি করলাম। সহজে কি সে কাজ করে দেওয়ার মানুষ? তাই জায়গামতো হালকা তাঁর প্রশংসা করলাম। এখন আমার কাপড় সে ইস্ত্রি করছে আর নিজ দক্ষতার বুলি শোনাচ্ছে, কি ভাব দেখাচ্ছে যেন এ কাজ তার পেশা। আমিও হে, হুম হুমম, বলে সাড়া দিতে লাগলাম। কারণ ভিন্ন মত পোষণ করলে হয়ত মাঝপথে হরতাল হবে।
এদিকে আমাদের প্রেজেন্টেশন টিম-লিডার ঐশী রাত চারটা পর্যন্ত সবার স্লাইড সমন্বয় করেছে। বেশ পরিশ্রমী লিডার। এ কাজ যদি সুব্রত বা অন্তর কিংবা আসিফ করতো, তাহলে সারা বারোমাস আমাকে খোঁটা দিত, যেন সে কলম্বাস কিংবা ভাস্কো দা গামার ন্যায় অসাধ্য সাধন করে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। এই দিক থেকে ঐশীর নেতৃত্ব আমার কাছে খুবই নিরাপদ।
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ঐ দিন উপস্থিত। সবাই পরিপাটি করে এসেছে। সবাই যেন বড় বড় অফিসার সাদৃশ্য। তবে এটা সত্য কেউ কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ না। জুতা বা প্যান্ট বা শার্ট সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে ধার করে নেয়া। প্রেজেন্টেশন শেষ হলে খুলে ফেলতে হবে পোশাকপরিচ্ছদ। তাই ছবি তুলছে সবাই এককভাবে কিংবা দলগতভাবে। নিজ নিজ টাইমলাইনে ফেসবুকে পোস্ট করবে অনেকে। কেউ ছবির সুন্দরতা বিবেচনায় প্রোফাইল ছবিও দেবে।
অতঃপর আতাউর স্যার ক্লাসে উপস্থিত। স্যারও আজ খুব পরিপাটি। তারপর গ্রুপ করে স্যার প্রেজেন্টেশন নিলেন। অস্কার কিংবা নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে দর্শকদের খানিক সময় পর পর করতালিতে যেভাবে গ্যালারিতে ছন্দ ওঠে, তেমনি আমাদের ছোট্ট গ্যালারিতেও উচ্ছ্বাসের স্বতঃস্ফূর্ততার কমতি ছিল না।
প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর স্যার আমাদের ঘাটতিগুলো তুলে ধরলেন। যারা টাই পড়ে এসেছিল, সবাইকে সামনে ডাকলেন এবং সৌন্দর্যের প্রশংসা করলেন। সেই সঙ্গে টাই টা কতটুকু উপরে উঠবে, কেমন হবে তা দেখিয়ে দিলেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের কমতি থাকারই কথা। কেননা ভালো করে টাই বাঁধতে পারে একমাত্র হাসনাত। সেই অর্থে এতজনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা সম্ভব নয় তার।
প্রেজেন্টেশনের পর ক্লান্ত মলিন চেহারায় সবাই স্যারের সাথে একটা গ্রুপ ছবি তুললো। কারও কারও আরো ছবির নেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের সুন্দর জায়গায় গিয়ে সুন্দর ছবির নিমিত্তে নিজেকে উৎসর্গ করল। সর্বোপরি একটি সুন্দর দিনের সমাপ্তি হলো।
বাস্তবভাবে অনেক কিছু শিখলাম। আরও অনুধাবন করতে পারলাম ইংরেজিতে আরও দক্ষ হওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নিজের কমতি বুঝতে পারলাম এবং স্যারের নির্দেশনায় নিজেকে সংশোধনের উপায় পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এগুলোই তো স্মৃতি। খানিকটা সময়ে ফরমাল পোশঅক পরিধান নাড়া দেয় কত সুপ্ত জীবন সাফল্যকে। অন্যদিকে ফেসবুকে সন্তানের ফরমাল পোশাক দেখে পিতা-মাতার হৃদ মাঝারে কে যেন ফিসফিস করে জানান দিচ্ছে "এইতো আর কটা দিন"
লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়